‘বারো ইয়ারি’ অর্থাৎ সকলে মিলে সমবেত উদ্যোগ হল বারোয়ারি। নদিয়ার সর্বপ্রাচীন বারোয়ারির নাম হিসাবে উঠে আসে শান্তিপুর ডাবরে পাড়া বারোয়ারির কথা। মূলত তন্তুজীবীর সম্প্রদায়ের মানুষজন ২৫০ বছরেরও আগে স্থাপন করেছিল তাদের বারোয়ারি। সেই সময় থেকে আজও পুজোর বিভিন্ন রীতিনীতির সঙ্গেই পাড়ার ছেলেদের অভিনীত যাত্রাপালার পরম্পরা ধরে রেখেছে।
আরও পড়ুন: গোটা দেশে পড়ল সাড়া…! ২ বছরেই চমকে দিল রাজমিস্ত্রির মেয়ে! কী এমন কাণ্ড করল? দেখুন
advertisement
যুগ্ম সম্পাদক পার্থ প্রামাণিক এবং প্রতাপ প্রামাণিকরা জানান, এবারে ২৫২তম বর্ষে তাঁরা পুজো উদ্বোধন করিয়েছেন দুর্বার মহিলা সমিতির যৌনকর্মীদের দিয়ে। শিশুদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, প্রান্তিক পরিবারের বস্ত্র দান, মুমূর্ষ রোগীদের উদ্দেশ্যে রক্তদান শিবির, অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষজনের জন্য চক্ষু এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির-সহ নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে পুজোর কটা দিন মশগুল ছিল এলাকাবাসী। তবে মায়ের বিসর্জনের বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে, বিজয়া সম্মেলনী হিসাবে, পাড়ার ছেলেদের অভিনীত যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হল এদিন।
আরও পড়ুন: পাবদা মাছ ভালোবাসেন? খেলে শরীরে কী হয় জানেন তো…? আরেকবার খাওয়ার আগে জানুন বিশেষজ্ঞের মত
এলাকারই ৬৪ বছর বয়সি অসীম প্রামাণিক জানান, এক সময় তাঁদের পাড়ার পূর্বপুরুষদের অভিনীত যাত্রাপালা সিরাজদৌল্লা সুনাম অর্জন করেছিল সারা বাংলা জুড়ে। তবে বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাঁত শিল্পের মতোই গ্রাম বাংলার এই শিল্প হারাতে বসেছে। তবে তাদের বারোয়ারি আজও সেই পরম্পরা ধরে রেখেছে।
নিজে এই বয়সেও অভিনয় ছাড়েননি, এলাকার ১৭ জন বিভিন্ন বয়সি ব্যক্তিদের নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে, বিমান মণ্ডলের লেখা অনুযায়ী যাত্রাপালা “মা রেখেছি মাইনে করে, বউ রেখেছি পায়ে ধরে” আজ থেকে প্রায় দুমাস আগে থেকে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তা উপস্থাপিত হয়েছে। তবে তিনজন মহিলা চরিত্রের অভিনেত্রী সাজসজ্জা মিউজিসিয়ান লাইট মেকআপ আর্টিস্ট পোশাক এসবই ভাড়া নেওয়া, তাই খরচটা অনেকটাই বেড়ে গেছে। সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রাপালা সন্ধ্যা আটটা থেকে শুরু হয়ে রাত বারোটায় শেষ হয়েছে।
কাটোয়া থেকে আগত মেকআপ আর্টিস্ট জনি শেখ জানাচ্ছেন, তিনি মূলত সারা বছর দিনমজুরের কাজ করেন তবে বাবার মৃত্যুর পর এই মেকাপের কাজের ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রেখেছেন পরম্পরা হিসাবে। চুল দাড়ি মেকাপের বিভিন্ন সামগ্রি সবটাই নিজেকে নিয়ে আসতে হয় তার ওপর আসা যাওয়া মিলিয়ে মোট দুদিন কাজের ক্ষতি সেই অর্থে পারিশ্রমিক নেই, তাই এই পেশায় লোক কমছে ক্রমশ।
কৃষ্ণনগর থেকে আগত অভিনেত্রী যোগমায়া গুহ জানাচ্ছেন তিনি ৩২ বছর ধরে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন বর্তমান তাঁর বয়স ৬৫। একসময় স্বামী মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন তাঁর সঙ্গেই প্রথম অভিনয় মঞ্চে পা রাখা। তবে তিনি এখন অসুস্থ, ছেলেরা কোনরকমে দুটো উপার্জন করতে শিখলেও সংসারের হাল ফেরাতে আজও বিশ্বস্ত সহকর্মীদের সঙ্গে রাতবিরেতে পালা করতে পৌঁছে যান বিভিন্ন জেলায়, তবে পরিবার বা সমাজ থেকে কোন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি কোনদিন। আক্ষেপ শুধু একটাই বর্তমান সরকার বিভিন্ন শিল্পীদের পরিচয় পত্র এবং ভাড়ার ব্যবস্থা করলেও তাদের নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা শুরু করেননি। তবে তিনি এ বিষয়ে আশাবাদী আগামীতে নিশ্চয়ই তাদের মতন অভিনেত্রী কিংবা যাত্রার কাজে যুক্ত বিভিন্ন ধরনের শিল্পীরা নিশ্চয়ই মর্যাদা পাবে।
তবে যাত্রাপালার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে থাকা স্থানীয় কাউন্সিলর দীপঙ্কর সাহা বলেন, তিনি গর্বিত এই এলাকার কাউন্সিলর হতে পেরে, মায়ের বিসর্জনের পরেও এতটুকু আনন্দের ঘাটতি হয় না এই পাড়ায়। তবে শিল্পীদের সরকারি সহযোগিতার ব্যাপারে তিনি বলেন মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বাউল লোকগীতি এবং বিভিন্ন ধরনের বাদ্য শিল্পী, আদিবাসী নৃত্য-সহ বিভিন্ন শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তেমনই হয়তো এই বিষয়টিও তার সুনজরে রয়েছে। তবে স্থানীয় ভাবে বিধায়ক এবং চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় তিনি বরাবরই এই বারোয়ারির পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী থাকতে চেষ্টা করেছেন।
মৈনাক দেবনাথ