ছাতিমতলা শব্দটি শুনলেই হৃদয়ে ভেসে ওঠে শান্তিনিকেতনের কথা। কিন্তু শুধুমাত্র বীরভূমেই নয়, মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার প্রত্যন্ত সাহাজাদপুর গ্রামে গেলেও দেখা যাবে আর এক ছাতিমতলাকে। সেখানকার ৪৩ নং সাহাজাদপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে ঢুকতেই চোখ কাড়বে বেদীসহ ছাতিম গাছ।
এর পরিকল্পক ছিলেন জাতীয় পুরস্কারজয়ী প্রাবন্ধিক-গবেষক ডঃ সায়ন্তন মজুমদার। পাশাপাশি তিনি তুলনামূলক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নতুন দিশারীমূলক গ্রন্থ ’তৌলনিক অনুভাবনে শ্রীরবীন্দ্রনাথ’ এবং অপ্রকাশিত চিঠিনির্ভর ‘রবিলিপিকর শ্রীসুধীরচন্দ্র কর’ নামক দুটি অমূল্য গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁরই স্বল্পকালীন শিক্ষকতাপর্বে এই বিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদের শান্তিনিকেতন। ২০১৭ সালের বাইশে শ্রাবণ আজান ও শঙ্খধ্বনি সহযোগে, ফুলের আলপনার মধ্যে গ্রামে প্রথম ছাতিম গাছ রোপণ করা হয়।
advertisement
আরও পড়ুন: সময়ের আগেই বন্ধ স্কুল! হানা দিলেন পৌরসভার চেয়ারম্যান
বোলপুরের বর্ষামঙ্গল উৎসবের পঞ্চভূতের আদলে উপস্থিত ছিল স্কুলের পাঁচজন ছাত্রছাত্রী। তাদের পরনে ছিল সবুজ(পৃথিবীর প্রতীক),সাদা(জল),কমলা (আগুন), ধূসর (হাওয়া),আকাশী (আকাশ) পোশাক। সেদিন বিশ্বভারতীর হলকর্ষণ উৎসবের মতো ছোট্ট একটি জায়গা লাঙ্গল দিয়ে চষে দেয় কৃষকের বেশে সাজানো ছাত্ররা। তাতে ধানগাছ রোপণ করে লক্ষ্মীরূপে সাজানো এক মুসলমান ছাত্রীকে। লক্ষ্মী নামে এক ছাত্রীর হাতে ধরানো হয় লক্ষীর ঝাঁপি।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রমৃত্যুতে যেসব ফুল (পদ্ম, চাঁপা) নিবেদিত হয়েছিল সেই সকল ফুল নিবেদন করা হয় রবীন্দ্রচিত্রে। এর সঙ্গে রাখা হয় রাখী। কারণ রবীন্দ্র প্রয়াণের দিনটিতে ছিল রাখীবন্ধন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই সেই ছাতিমতলায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তিজ্ঞানবেদী। তাতে লেখা রয়েছে—‘এই বিদ্যালয় আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি, মাতৃসমা শান্তিনিকেতন’। শান্তিনিকেতনের ছাতিমবেদীর ফলকে লেখা কথাটির অসাধারণ সংযোজন এটি।
শুধু তাই নয় এর ভিতের নীচে তিনি পুঁতে দিয়েছিলেন তাঁর নিজের হাতে করা স্কুলের লোগো,পতাকা, ধ্যেয়বাক্য, স্কুলসংগীত,বঙ্গাব্দ-হিজরি-খ্রিস্টাব্দের তারিখ দেওয়া ভিত্তিস্থাপনের প্রতিষ্ঠালিপি। সঙ্গে মহাভারত-কোরান-বাইবেল হতে আহরিত জ্ঞানবিষয়ক বাণী। ব্যবহৃত হয় মানস সরোবর, কাশীর গঙ্গা, জমজম কুয়ো, পাথরচাপুরির জল। পাঠ করা হয় রবীন্দ্রকবিতা, কোরান ,বাইবেল,বেদের কিছু অংশ।
আরও পড়ুনঃ নদীয়ায় উদ্ধার হওয়া কুমিরটি ছাড়া হল ফরাক্কার গঙ্গায়
আজ তিনি সেই স্কুলে না থাকলেও রয়ে গিয়েছে সব ধর্মের প্রতীককে মেলানো ছাতিমতলা, যা নবাবের দেশে এক অন্য শান্তিনিকেতন তৈরি করেছে। বিশ্বভারতীর শতবর্ষকে মনে রেখে বেদীতে রয়েছে একশোটি দাগ। শিল্প-শারদ-পৌষ-বসন্ত-আলোর উৎসব পালন, রবীন্দ্র অনুষঙ্গে মনীষীর স্মরণ সর্বোপরি উন্নত লেখাপড়ার মাধ্যমে সত্যি এই স্কুল বিশ্বের নীড়ে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক ডঃ মজুমদার স্মৃতিমেদুর হয়ে জানিয়েছেন, ‘আমার রবীন্দ্র গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ করে ওই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে তাকে দেশের শিকড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। বীজরুপী শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে আমরা যেহেতু মহীরূহুসম বিশ্বভারতীকে পেয়েছি, সেই ধারা অনুসরণ করে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্বসম্মিলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদ রচনা করেছিলাম।
কৌশিক অধিকারী