পশ্চিম মেদিনীপুরের মোগলমারির নামকরণ নিয়ে নানা ইতিহাস রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দে দাঁতনের তুকারই এলাকায় মোঘল-পাঠানের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মোগলদের বহু ক্ষতি হয়। তাই সেখান থেকে মোগলমারি নাম হতে পারে। অন্যদিকে মনে করা হয় মোঘলরা এই পথ হারিয়ে গিয়েছিল বলে মোগলমারি, সেখান থেকে কালের বিবর্তনে মোগলমারি নাম হয়েছে।
advertisement
ইতিহাস নিয়েও গবেষকদের মতে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই গ্রামের নাম ছিল অমরাবতী। সেই অঞ্চলের রাজা বিক্রমাদিত্যের কন্যা সখীসেনার অধ্যয়নের জায়গা ছিল এটি। সেখান থেকে এই নাম এসেছে বলে মনে করা হয়। মোগলমারির এই প্রত্ন ক্ষেত্র একটি পাঠশালা বলে মনে করা হয়।
আরও পড়ুন - West Medinipur News|| ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো, মার্শাল আর্টে সোনা জয় গাড়ি চালকের মেয়ের
অন্যদিকে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তার গ্রন্থ সি ইউ কি' তে বঙ্গদেশের চার রাজ্যের বিশেষ বর্ণনা করেছিলেন- পুন্ড্রবর্ধন, সমতটী, কর্ণসুবর্ণ এবং তাম্রলিপ্ত। এই তাম্রলিপ্ত রাজ্যে ১০টি বৌদ্ধবিহার ও এক-হাজার বৌদ্ধ সন্নাসীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ যাবৎ কাল পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত সন্নিহিত অঞ্চলে কোন বৌদ্ধবিহার-ই আবিষ্কৃত হয়নি, মোগলমারি ব্যতীত।
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন স্থলের মধ্যে মোগলমারি অন্যতম। যা আজ সখীসেনার পাঠশালার সকল জনশ্রুতির দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অবস্থিত অন্যান্য বৃহৎ ও প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯৯৯ সালে সুবর্ণরেখার গতিপথ ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক অশোক দত্ত দাঁতনের মোগলমারিতে এসে, সখিসেনা ঢিবি নামে এক ঢিবির সন্ধান দেন।
আরও পড়ুন - Viral News|| পাত্র-পাত্রী খোঁজাই নেশা, বিয়ে দিয়েছেন ১৬৪৯ জোড়ার, চিনুন 'নায়ক' সনাতনকে
২০০৩-০৪ সাল নাগাদ খনন কার্য শুরু হয় দাতনের মোগলমারিতে। খননে পাওয়া যায় নকশাযুক্ত ইট, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের কুঠুরি। পাওয়া যায় ত্রিরথ কাঠামো যুক্ত নক্সা, যা দেখে গবেষকদের প্রাথমিক অনুমান স্থানটিতে মন্দির বা গর্ভগৃহ ছিল। গ্রামের অভ্যন্তরে খনন চালিয়ে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধস্তূপ ও এক বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। এরপর ২০০৬, ২০০৭ সাল নাগাদ খননে ঢিবির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাওয়া যায় নক্সা যুক্ত ইট দ্বারা সুসজ্জিত দেওয়াল, স্টাকো পলেস্তারা যুক্ত দেওয়াল, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি। উদ্ধার হয় খণ্ড বিখণ্ড বুদ্ধের মূর্তিও।
এরপর থেকে একের পর এক খননে নানান ইতিহাসের দলিল উদ্ধার হয়।
ইতিহাস গবেষকরা জানিয়েছেন এটি ছিল একটি মহাবিহার। মহাবিহারটি গঠন শৈলী ত্রিরথ কাঠামোর। পশ্চিমবঙ্গের আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার গুলির মধ্যে অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর ২০১৩ মোগলমারি ‘সখীসেনা ঢিবি’-কে রাজ্য সংরক্ষিত সৌধের মর্যাদা প্রদান করে এবং রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহশালা অধিকারের অধীনে মোগলমারিতে সপ্তম পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের কাজ।
পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে মোগলমারীতে বৌদ্ধ বিহারের সংরক্ষণ ও সাজিয়ে তোলার কাজ হয়েছে। বেশ কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরি হবে মোগলমারি মিউজিয়াম ও। স্বাভাবিকভাবে পর্যটনের নতুন দিশা হবে দাঁতনের এই মোগলমারী বৌদ্ধবিহার।
Ranjan Chanda