চিলকিগড়ের ইতিহাস:
কথিত আছে, জঙ্গলমহলের রাজা ছিলেন গোপীনাথ সিং। তাঁর রাজ্যের নাম জাম্বনি, যার রাজধানী চিলকিগড়। ডুলুং নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত তাঁর প্রাসাদ। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি চিলকিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ স্বপ্নাদেশ পেয়ে তার ৩ রানির হাতের কাঁকন দিয়ে তৈরি করেন দেবী কনকদুর্গার মূর্তি৷ চতুর্ভুজা এই দেবী অশ্ববাহিনী৷ বাঁদিকের দুই হাতে রয়েছে খর্পর ও অশ্বের লাগাম৷ ডানহাতে খড়্গ ও বরাভয়৷ অলঙ্কারে সজ্জিত দেবীর গায়ে ছিল নীল বস্ত্র৷ ১৯৬০ সালে আসল মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়৷ ১৯৯৬ সালে গোপীনাথের বংশধররা অষ্টধাতুর কনকদুর্গার একটি রেপ্লিকা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ গোপীনাথ সিংয়ের ছিল ৪ পত্নী। রানি গোবিন্দমনি, চম্পামনি, ঠাকুরমনি ও দুর্গামনি। চার রানির মধ্যে একমাত্র চম্পামনির একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম সুবর্ণমণি। রাজার কোনও পুত্রসন্তান ছিল না।
advertisement
পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা ছিলেন জগন্নাথ দেও ধবলদেব ৭ম। রাজা জগন্নাথের বিয়ে হল চিলকিগড়ের রাজার মেয়ে সুবর্ণমণির সঙ্গে। সুবর্ণমণি হলেন জগন্নাথের তৃতীয় স্ত্রী। ফলে জামবনি রাজ্যের সঙ্গে ধলভূমগড় রাজ্যের যোগসূত্র তৈরি হল। গোপীনাথ সিং মারা যান ১৭৬৫ সালে। তাঁর চিতায় 'সতী' হয়ে প্রাণত্যাগ করেন দুই রানি, চম্পামনি ও ঠাকুরমনি। অন্য দুই রানির মধ্যে, গোবিন্দমনি মারা যান ১৮১৮ সালে। ১৮২২ সালে মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে একটি মামলার আদেশ অনুযায়ী চিলকিগড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে সাব্যস্ত হলেন ধলভূমগড়ের সুবর্ণমনির পুত্র অর্থাৎ গোপীনাথের দৌহিত্র, কমলাকান্ত দেও ধবলদেব।
ধলভূমগড়ের রাজপুত্র এসে দখল করল চিলকিগড় রাজ্য। কে তৈরি করে রাজত্ব, আর কে এসে তা খেয়ে যায় ! এটাই হয়তো কালের নিয়ম। যখন মানগোবিন্দ দেও ধবলদেব ছিলেন চিলকিগড়ের রাজা, তাঁর সময়কেই বলা হয় চিলকিগড়ের সুবর্ণ সময়। তিনি শিল্প সংস্কৃতির ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। চিলকিগড়ের শেষ রাজা ছিলেন জগদীশচন্দ্র । তিনি বিয়ে করেছিলেন ত্রিপুরার রাজকন্যা তড়িৎপ্রভা দেবীকে। তাঁদের ছিল ৭ পুত্র ও ৬ কন্যা। জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গেই চিলকিগড়ের রাজত্বের অবসান হয়।
চিল্কিগড়ের পরিবেশ।
ঝাড়গ্রামের ‘কিষ্কিন্ধ্যা’ চিলকিগড়ে এখন মহা আনন্দে বালী-সুগ্রীবের চিলকিগড়ের বংশধরেরা। চিলকিগড়ে এখন আর বানরকুলের খাদ্যের অভাব নেই। ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি ব্লকের ডুলুং নদী অববাহিকায় ৬১ একর জুড়ে চিলকিগড় কনক দুর্গা মন্দিরের বিস্তার৷ একে ঘিরে রয়েছে প্রায় তিনশোর বেশি প্রজাতির প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়া ও ভেষজ উদ্ভিদ। উদ্ভিদ-বৈচিত্রে এই অরন্য যেন, অনেকটা দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের আমাজন নদী অববাহিকার ‘সেলভা’ রেইন ফরেষ্টের ক্ষুদ্র সংস্করন৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চিলকিগড় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে রাজ্যের মানচিত্রে অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছিল।
পর্যটকদের আকর্ষন বাড়াতে ২০০৮ সালে ‘রাজ্য পর্যটন দফতর’ এখানে ২০ টি হনুমান ছেড়ে দেয়। সেই সংখ্যাটি এখন বেড়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০/৬০০ তে। ভেষজ গাছপালা, ফলমুল ও পর্যটকদের দেওয়া খাবারের প্রাচুর্যতায় দ্রুতহারে বংশ বৃদ্ধি করায় হুহু করে বাড়ছে বানরকুলের সংখ্যা৷ উদ্ভিদ বৈচিত্রের ‘হটস্পর্ট’ চিল্কিগড় জঙ্গল এলাকাটিকে ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ হেরিটেজ ঘোষণা করেছে৷ তাই, জঙ্গল এলাকায় আগুন জ্বালানো, ধূমপান, মদ্যপান, প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
প্রকৃতি:-
চিলকিগড়ে গিয়ে পৌঁছলেই মনে হবে প্রকৃতি তার সব রূপ যেন ঢেলে দিয়েছে। নদী, ছায়াঘন জঙ্গল, গাছে গাছে রঙবেরঙের প্রজাপতি কি নেই সেখানে। জঙ্গলের মধ্যে কনকদুর্গা মন্দির, ডুলুং নদী এবং জঙ্গলের টানে পর্যটকের ভিড় এখানে লেগেই থাকে বছরভর। কিন্তু, রাতে থাকার ঠিকঠাক ব্যবস্থা না থাকায় মুখ ফেরাচ্ছিলেন পর্যটকরা। এবার সেই কালিমা ঘুচিয়ে নবরূপে তৈরি চিলকিগড়। জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় দু’কামরার অতিথিশালা রয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে মন্দির চত্বরে সৌন্দর্যায়নের কাজ হয়েছে। একটি পরিখা করে বোটিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ ও পঞ্চায়েত সমিতির টাকায় মন্দির চত্বরে বসানো হয়েছে বিশালাকৃতি ডাইনোসর, হাতি, হরিণ ও কুমিরের মডেল।শাল, মহুল, কেঁদ, অশ্বথ, আমলকি, হরিতকির মতো প্রায় সাড়ে তিনশো থেকে চারশ প্রজাতির গাছ রয়েছে চিলকিগড় সংলগ্ন অরণ্যে৷ রয়েছে ১০৮ রকমের দুষ্প্রাপ্য ভেষজ গাছ-গাছড়ার সমারোহ৷ মাঝে ঐতিহ্যের গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে চিল্কিগড় রাজবাড়ি৷ এরই মাঝে কণকদুর্গার মন্দির৷ পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে ছোট ডুলুং নদী৷ তবে হ্যাঁ বাঁদরকুলের দৌরাত্ম থেকে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়৷
কিভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে সড়ক পথে চিল্কিগড়ের দূরত্ব ১৮২ কিমি। ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র ১৬ কিমি দুরত্ব চিলকিগড়ের।
Partha Mukherjee