আজকের আধুনিক শহর দুর্গাপুরের রূপকার বলে মনে করা হয় বিধানচন্দ্র রায়কে। তবে দুর্গাপুরকে আধুনিক শহর দুর্গাপুরে রূপান্তর করাটা সহজ ছিল না মোটেও। ঘরে-বাইরে শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেই বিধানচন্দ্র রায় বুজেছিলেন সঠিক পরিকল্পনা করলে দুর্গাপুরকে শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সেইসঙ্গে কলকাতার বাইরে দক্ষিণবঙ্গে আরও একটি অত্যাধুনিক শহর পাবে বাংলার মানুষ। এর জন্য তাঁকে কম লড়াই করতে হয়নি।
advertisement
বিধানচন্দ্র রায় দুর্গাপুরকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের দল কংগ্রেস সেই সময় কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকলেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবকে বিশেষ একটা আমল দেয়নি তারা। তবে দক্ষ প্রশাসক বিধানবাবু কেন্দ্রের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি। রাজ্য সরকারের চেষ্টাতেই দুর্গাপুরকে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। পরে অবশ্য সম্ভাবনার বিষয়টি বুঝতে পেরে অবস্থান পাল্টে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল কেন্দ্রও। দিল্লির সম্মতি পাওয়ার পরই দুর্গাপুরে শুরু হয় ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার কাজ।
আরও পড়ুন: স্ট্যাম্প কালেক্টর সুহৃদ মুখার্জির ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাবে কে
দুর্গাপুরে ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলার জন্য প্রথম দরকার ছিল জমি অধিগ্রহণের। যার মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল কৃষি জমি। তবে ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠলে ওই এলাকার কতটা উন্নতি হতে পারে তা আগেই বুঝেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। এই কাজে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেন দুর্গাপুরের ভূমিপুত্র তথা রাজনীতিবিদ আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়।
বিধানচন্দ্র রায়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাঁর পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। আর তাই দুর্গাপুর গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে এসে সরকারের হাতে জমির দলিল তুলে দেন সেখানকার কৃষকরা। ফলে বিরোধীদের একাংশ সেই সময় এই দুর্গাপুর প্রজেক্টেরর বিরোধিতা করলেও তা ধোপে টেকেনি।
দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা তৈরির পর সেখানে ধীরে ধীরে আরও কারখানা গড়ে ওঠে। অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, দুর্গাপুর ফার্টিলাইজার কোম্পানি ইত্যাদি কারখানাগুলো জায়গা করে নেয় দুর্গাপুরের বুকে। এই সমস্ত কারখানাকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার তৈরি করে দুর্গাপুর প্রজেক্ট লিমিটেড। যা বর্তমানে ডিপিএল নামে পরিচিত। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করে ডিটিপিএস। এদিকে এই কারখানাগুলোতে কাজের জন্য বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ দুর্গাপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। এমনকি অন্যান্য রাজ্য থেকেও অনেকে আসেন। আর এই ভাবেই দ্রুত সম্পূর্ণ হয় দুর্গাপুর শহর গড়ে তোলার কাজ।
আরও পড়ুন: পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু পরিচারিকা মহিলার, দিশেহারা ২ নাবালক সন্তান
এই প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ তথ্য আছে। বিধানসভায় দুর্গাপুরের বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় বিধান বাবু সেখানকার ভূমিপুত্র আনন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় কে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে কেন দুর্গাপুর গিয়ে নতুন একটি শহর হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন এই সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে কিন্তু এর পরই আসে বড় চমক কলকাতার বাসিন্দা বিধানচন্দ্র রায় প্রায় 40 মিনিট ধরে দুর্গাপুর সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। সেখানে দুর্গাপুর শহর সম্বন্ধে এতো বিস্তারিত তথ্য ছিল যে চমকে গিয়েছিলেন আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়’ও।
বিধানচন্দ্র রায় লেগে পড়েছিলেন বলেই আজ দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীতে পরিণত হয়েছে, এমনটাই মনে করেন অনেকে। দুর্গাপুরকে বহু মানুষ বিধানচন্দ্র রায়ের দান বলে চিহ্নিত করে থাকেন।
এদিকে শোনা যায়, প্রফুল্ল ঘোষের জায়গায় যখন বিধানচন্দ্র রায়কে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তখন সহজে রাজি হননি বিধানবাবু। কারণ লন্ডন থেকে পড়াশোনা করে ফিরে তিনি পুরোদমে চিকিৎসায় নিজের নজর দিয়েছিলেন। সেই সময় চিকিৎসা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মূলত অতুল্য ঘোষের জোরাজুরিতেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে হয়। তবে অনেকেই মনে করেন বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বলেই দুর্গাপুর গড়ে ওঠে।
(তথ্য সূত্র – ডা: সুশীল ভট্টাচার্য, জাতীয় শিক্ষকতা পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক)
নয়ন ঘোষ