এ ছাড়া নাইট ক্যুইনকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলা হয়। মনে করা হয় যে বাড়িতে ফুলটি ফোটে তাঁর বাড়িতে সৌভাগ্য বয়ে আনে। সন্ধ্যা থেকেই ফুল ফোটা শুরু হয়। এক সময় সবগুলো পাপড়ি ছড়িয়ে অপার সৌন্দর্যে বিলিয়ে দেয় চারদিকে। ক্যাকটাস জাতীয় এ উদ্ভিদের আদি নিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল ও মেক্সিকো। তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও এই ফুলের বিচরণ অবাধ। ফুলপ্রেমীদের হাত ধরে আমাদের দেশে বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে নাইট ক্যুইন বা ব্রহ্মকমল চোখে পড়ে। এর ইংরেজি নাম: Dutchmans pipe ও Queen of The Night. উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম: Epiphyllum oxypetalum।
advertisement
এ প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ অর্ণব সেন বলেন, 'রাতে ফোটা এই ফুলটি দেখতে অপূর্ব সুন্দর হয়। সঙ্গে একটি মিষ্টি গন্ধযুক্ত হয়। এই ফুলটিকে আমরা এপিফাইলাম অক্সিপেটালাম বলে চিহ্নিত করি। তবে একে বাংলায় বিভিন্ন নামে চেনে। কেউ একে নিশিপদ্ম বলে। কেউ একে নিশিগন্ধা। আবার কেউ একে ’ব্রহ্মকমল'ও নামে চেনে। তবে এই নামে আরও কিছু গাছ রয়েছে যাদের এই নামে বা নাইট ক্যুইন নামে ডাকা হয়। সুতরাং অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন।' বলেন, 'নিশিপদ্ম বা ব্রহ্মকমলে ফুল খুব স্বল্প সময়ের জন্যই প্রস্ফুটিত হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধার্মিক স্থানেও নিশিপদ্ম বা ব্রহ্ম কমলের ব্যবহার রয়েছে। হিন্দু বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে ব্রহ্ম কমলের ব্যবহার রয়েছে। ভারতের কেদারনাথ ও বদ্রিনাথ মন্দির গর্ভে এই ফুল দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং বলা বাহুল্য ধর্মীয় আবেগও বয়ে নিয়ে চলেছে এই ফুলটি।'
অর্ণববাবু বলেন, 'তবে শুধু ধর্মীয় স্থানেই নয় এই ফুলে রয়েছে বিভিন্ন ঔষধি গুণ। এই ফুলের গাছে রয়েছে প্লান্ট স্টেরয়েড। ফলে এই গাছের ফুল এবং পাতার ব্যবহার বৃহৎ পরিসরে। প্রদাহ থেকে শুরু করে টিউমার এমনকি ক্যান্সার রোগের ক্ষেত্রে রামবান ওষুধ হতে পারে এই নিশিপদ্ম বা ব্রহ্ম কমল। অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লামেটরি হিসেবে এর ব্যবহার বিশাল। এমনকি মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার অনস্বীকার্য। যাদের হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ এমনকি ব্লাডক্লট বা রক্ত জমাটের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার বিপুল। পাশাপাশি এই ফুলের গাছে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে রামবাণ ওষুধ হিসেবে কাজ করে।'
ব্রহ্মকমল বা নিশিপদ্ম (নাইট ক্যুইন) আদতে বর্ষার ফুল। অন্যান্য যে কোনও ফুলের থেকে আলাদা। শিলিগুড়ি হর্টিকালচার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত সেন বলেন, 'ব্রহ্মকমল বা নিশিগন্ধা অর্কিড-ক্যাকটাস জাতীয় ফুল। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এমনকি কালিম্পংয়ের বিস্তীর্ন এলাকায় এই ফুলের সন্ধান মেলে। বর্ষার শুরুতে বা বর্ষা আসার প্রাক মুহূর্তে যখন তাপমাত্রা ২৮° - ৩০° থাকে তখন নাইট ক্যুইন বা ব্রহ্ম কমল নিজের বিস্তারিত রূপ তুলে ধরে।'
প্রশান্তবাবু আরও বলেন, 'নাইট ক্যুইন সরাসরি মাটি ও টবে রোপণ করা যায়। উঁচু ভূমি জল নিকাশের সুবিধাযুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে নাইট ক্যুইন ভাল জন্মায়। চারাগাছ থেকে ফুল ফুটতে সময় নেয় পাঁচ থেকে সাত বছর। এর চারা তৈরি হয় পাথরকুচি গাছের মতো পাতা থেকে। নরম মাটিতে পাতা রেখে দিলে ধীরে ধীরে চারা গজায়। এরপর চারা বড় গাছে পরিণত হয়। গাছের পাতার রং সবুজ ও বেশ পুরু। উচ্চতা গড়ে ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফুল ফোটার আগে গাছে প্রথমে গুটি গুটি কলি ধরে। এরপর কলি বড় হয়ে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ফুল ফোটার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। যে রাতে ফুল ফুটবে তার ৭২ ঘন্টা আগেই কলিটি এমনকি সেদিন বিকেল থেকেই কলিগুলো অদ্ভুত সাজে সাজতে থাকে। তখনই বোঝা যায় নাইট কুইনের ফোটার সময় হয়েছে। এক সময় অর্থাৎ রাত ৭-৯টার মধ্যে ব্রহ্ম কমল বা নিশিপদ্ম তার কাঙ্খিত রূপটি ধরে। এইরূপ ধরে নাইট ক্যুইন তার সৌরভ ছড়ায় পরদিন ভোর ৫-৬টা পর্যন্ত। এরপর সূর্যের দাপটের সঙ্গে ব্রহ্ম কমলও নিজেকে মুদিয়ে নিতে থাকে এবং একটা সময়ে ঝরে পড়বে। তবে নিশিগন্ধা বা ব্রহ্মকমলের এই লীলা সবই চলে রাতের আঁধারে।'
এককথায় প্রতীক্ষার যে ধৈর্য্য, তারই প্রতীক এই ব্রহ্ম কমল। এর বিশেষ কোনও বানিজ্যিক মূল্য নেই, কারণ একটাই। রাতের আঁধারে ফোটে এই ফুল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য নিজেকে তুলে ধরে। এই কারণে বানিজ্যিক মূল্য নেই বললেই চলে। লম্বা বোঁটায় নমনীয় কোমল পাপড়ির সমন্বয়ে সৃষ্ট নাইট ক্যুইন বা নিশিপদ্ম। মাঝে পরাগ অবস্থিত। ফুলের রং প্রধানত সাদা। তবে সাদা রঙের ফুলে মাঝে ঘিয়ে রঙের মিশ্রণ ও সুমিষ্ট গন্ধ থাকে। রাত শেষ হওয়ার আগেই ঝরে যায়। অর্থাৎ ভোরের আলো ফোটার আগেই জীবনাবসান। তাই তো ফুলটিকে দুর্লভ ফুল বলে আখ্যা দেন অনেকে।