গত বছরের নিরিখে এ বছর নিলামে ওই দার্জিলিং চায়ের দাম কমেছে ১০০ টাকারও বেশি। দেশের বাজারে নিলামে দার্জিলিং চায়ের দাম বেশি উঠছে না বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। দার্জিলিং চা পাতাকে আগে এমন দাম-সংকটের মুখে পড়তে হয়নি বলেই অভিমত চা শিল্প সংস্থাগুলির।
অন্যদিকে, দার্জিলিংয়ের চা শিল্পের বর্তমান সংকটের কারণ হিসেবে ভারত নেপাল বাণিজ্য নীতিকে দায়ী করেছে তেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (Terai Indian Planter\'s Association - TIPA)। ইতিমধ্যে সংগঠনের তরফে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের অভিযোগ, ভারত থেকে নেপালে এই চা রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হচ্ছে। সেখানে নেপালের তৈরি চা ভারতে এলে কোনও শুল্ক নেওয়া হচ্ছে না। যেখানে গুণগত মানে হাজারগুণ ভালো ভারতের দার্জিলিং, মাকাইবাড়ি ও শিলিগুড়ি সুকনা চা-বলয়ের চা ধীরে ধীরে তার বাজার এবং কৌলিন্য হারাতে বসেছে।
advertisement
টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (Terai Indian Planter's Association - TIPA) -এর চেয়ারম্যান মহেন্দ্রপ্রসাদ বানসাল নিউজ ১৮ লোকালকে (News 18 Local) বলেন, 'শুল্ক বিভেদ যেন সবটাই ভারতের। আমাদের ভারতের দার্জিলিং মাকাইবাড়ি বা সুকনার চাপাতা নেপালে গেলে ৪০ শতাংশ শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে রপ্তানিতে ৯০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এতে চা-চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনই চা-বলয়ের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি স্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।' বলেন, 'রাজ্য সরকারকে বারবার বলেছি, কিন্তু ইন্টারন্যাশানাল (International) স্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। তা না হলে ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী চা শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।'
এদিন মহেন্দ্রবাবু একপ্রকার ক্ষোভের সুরে নিউজ ১৮ লোকালকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের অতিসত্বর এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভাবতে অবাক লাগে যেখানে বারবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলেন, সেখানে ভারতের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প চা শিল্প আজ এতটা কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। কারোর কোনও হেলদোল নেই।'
এদিকে, এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়িক সংগঠন সিআইআই (CII) -এর উত্তরবঙ্গ জোনের চেয়ারম্যান সঞ্জয় টিব্রিওয়াল বলেন, 'আমাদের সংগঠন সিআইআই (CII) এই বিষয়ে বারবার সরব হয়েছে। এমনকি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আমরা বিষয়টি অবগত করেছি। তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ঘটনাটি জানতে পেরে।' বলেন, 'আমরা সব ক্রেতা-বিক্রেতা (Buyers-sellers) ও স্টেকহোল্ডার্স (stakeholders) নিয়ে ইতিমধ্যে একটি কনক্লেভ (Conclave) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুজোর পর চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আমরা সেই কনক্লেভের (Conclave) তরফে একটি বৈঠকও করব।'
শুল্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সঞ্জয়বাবু আরও বলেন, 'ভারতের চা নেপালে যেতে হলে ৪০ শতাংশ কর দিতে হয়। সেখানে নেপালের চা ভারতে এলে ৫ শতাংশ জিএসটি (GST) কর ধার্য্য করা হয়। অর্থাৎ সমীকরণটি খুব পরিষ্কার! ভারতের বিভিন্ন চা-বলয় মার খাচ্ছে নেপালের কাছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এবিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া এবং তড়িঘড়ি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথা ভারতের দার্জিলিং (Darjeeling), মাকাইবাড়ি (Makaibari), সুকনার (Sukna TE) মতো ঐতিহ্যবাহী চা-বলয়গুলি তার কৌলিন্য হারাতে বসবে।'
পাশাপাশি, পরিসংখ্যান বলছে, নেপাল ১০ লক্ষ ৫০ হাজার কিলোগ্রাম চা তৈরি করত। এখন বর্তমানে ২৬০-২৭০ লক্ষ কিলোগ্রাম চা তৈরি করে ভারতের বাজারে রপ্তানি করছে। ২০১৮ সালে নেপাল থেকে ১৫৫ লক্ষ কিলোগ্রাম চা ভারতে রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই 'অর্থোডক্স (orthodox)' চা ছিল। যার মধ্যে প্রায় সবটাই ভেজাল। দার্জিলিংয়ের চায়ের মতো দেখতে এই নেপালের ভেজাল চা গুণগত মানের দিক থেকে শিলিগুড়ির সুকনার চায়ের সমতুল্যতা করতে পারবে না। সেখানে দার্জিলিং বা মাকাইবাড়ির চায়ের কথা তো বাদই দেওয়া চলে বলে জানিয়েছেন টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (Terai Indian Planter's Association - TIPA) -এর চেয়ারম্যান মহেন্দ্রপ্রসাদ বানসাল। মহেন্দ্রবাবুর এও অভিযোগ, 'একশ্রেণীর বিক্রেতা সেই চা দার্জিলিংয়ের অর্থোডক্স নামে বিক্রি করছে। হলি বাজার বসতে চলেছে দার্জিলিং, মাকাইবাড়ি ও শিলিগুড়ির সুকনার মতো ঐতিহ্যবাহী চায়ের। আমাদের এও মনে রাখতে হবে, দু'লক্ষ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রুটিরোজগার এই চা-বলয়। সুতরাং, কড়া হবে এখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।'
পাশাপাশি চা মালিকদের যুক্তি, নেপালে ভারতের মতো শক্তপোক্ত কোনও বাগিচা শ্রম আইন নেই। সে দেশের সিংহভাগ চা বাগান অসংগঠিত আকারে বা ক্ষুদ্র চা চাষীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সেখানে ভারতের চা শিল্পের টি বোর্ড (tea board) নির্ধারিত প্ল্যান্ট প্রটেকশন কোড (plant protection code - PPC) মেনে চলা বাধ্যতামূলক। ফুড সেফটি স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার (Food Safety Standard Authority of India - FSSAI) গাইডলাইন মেনে পাহাড়ের চা উৎপাদিত হলেও নেপালি এমন কোনও গাইডলাইন (guideline) মানা হয় না বলেও অভিযোগ। এছাড়াও ভারতে চা বাগান শ্রমিকদের খাতে পিএফ -এর পরিমাণ ১২ শতাংশ হলেও নেপালে তা মাত্র ৮ শতাংশ। এর ফলে নেপালে উৎপাদন খরচ যথেষ্ট কম। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বাজারে নেপালের চা দার্জিলিং চায়ের তুলনায় অনেক সস্তা ফলে দার্জিলিংয়ের চা নিজের দেশের বাজারেই মার খাচ্ছে।
অন্যদিকে শিলিগুড়ির সুকনা টি-এস্টেটের (Sukna TE) ডেপুটি ম্যানেজার (Deputy Manager) পার্থপ্রতিম চক্রবর্তীর গলাতেও একই সুর শোনা যায়। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'নেপালের চা কোন দিক থেকে আমাদের ভারতের চায়ের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে না। তার ওপর সংবাদ মাধ্যমেই শুনেছি নেপালের চায়ে নাকি ভেজাল পাওয়া গিয়েছে। সেখানে এই চা বাজারজাত হলে তো সকলের জন্য বিপদ ডেকে আনা।' পার্থবাবু বলেন, 'সরকার ও টি বোর্ডের (Tea board) কাছে আবেদন আপনারা বিষয়টি অতিরিক্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখুন ও বিবেচনা করুন। নইলে সাধারণের পাশাপাশি চা-বলয়ের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো ও তাদের পরিবারগুলোর করুণ অবস্থা হবে।'
ভাস্কর চক্রবর্তী