#শিলিগুড়ি: টাউন স্টেশন! এখন এখানে এলে বোঝাই দায় যে এককালে দুর্গাপুজো নিয়ে মাতামাতি হত। বাজার বসত! রেলওয়ে কমিটির দ্বারা এই পুজো শিলিগুড়ির সর্বপ্রথম দুর্গাপুজো ছিল।
বহু প্রাচীন এই স্টেশনে চলত জোড়া ঢাকের আওয়াজ, কোথাও আবার কাসর। ট্রেনের কু-ঝিকঝিক আওয়াজকে ছাপিয়ে শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। করোনা নামক দস্যুর আগমনের আগে যেন এই টাউন স্টেশনের চিত্রটা এই থাকত। তবে এখনও ভিড় সামলেই ঢাকিদের মহড়া দেখা যায় স্টেশনে।
advertisement
এখনও ষষ্ঠী, সপ্তমীতে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোক্তারা ঢাকিদের বায়না দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বায়না নিতে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকিরা জড়ো হন শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে। পুজো উদ্যোক্তারা স্টেশনে এসে তাঁদের বাজনা দেখে এবং বিচার করে আগাম ঢাকি বুকিং (booking) করেন।
১৯০৩-১৯০৫-এর মধ্যেই টাউন স্টেশনে পুজোর শুভারম্ভ করেন স্টেশন লাগোয়া একটি ক্লাবের সদস্যরা। টাউন স্টেশনে আগে ট্রেনে করে প্রতিমা আসত। অনেকেই পুজোর আগের দিন স্টেশনে রাত কাটিয়ে অপেক্ষা করতেন। পুজোর আগে বাজার বসত এখানেই।
মালদা, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রত্যেক বছর প্রায় দেড়শো এই স্টেশনে আসতেন। পাহাড় থেকে শুরু করে চা বাগান, এই সমস্ত জায়গার জন্য প্রতিমা আসত ট্রেনে করে। ঢাকিরাও বাদ পড়ত না। তাঁদের বাজনশৈলী দেখে বিচার করে নিয়ে যাওয়া হত। সমগ্র জায়গার পুজো কমিটিগুলি স্টেশন থেকে ঢাকিদের নিয়ে যেতেন।
এক ঢাকির মুখে শোনা যায়, 'আমরা এখানে বহু বছর ধরে আসছি। এই স্টেশনে যেমন আমরা থাকি। ঠিক তেমনি এই স্টেশন আমাদের অন্নের জোগান দেয়। এখানে বিভিন্ন পুজো কমিটি ও পুজো উদ্যোক্তারা আসেন।'
তাঁদের কাছেই জানা যায়, বুকিং (booking) হওয়ার আগে পর্যন্ত স্টেশন চত্ত্বর বাড়ি হয়ে ওঠে। এই বাড়িতেই তাঁদের থাকা-খাওয়া সবকিছু সারতে হয়। কেউ কেউ আবার হাঁড়ি, কড়াইও নিয়ে এখানে রান্না সারেন। তবে সেখানেও রয়েছে আভ্যন্তরিন সমস্যা। শৌচাগার, পানীয় জল ইত্যাদি নিয়ে সমস্যার যেন শেষ নেই।
সাময়িকভাবে কেউ কেউ রেলের শৌচাগার ব্যবহার করেন, কেউ চলে যান জেলা হাসপাতালের সামনে থাকা সুলভ শৌচালয়ে। তবে এই স্টেশন চত্বরেই ভিড়ের ঢল নামে পুজোর আগে।
ঢাকি বুকিং করতে পুজোর সময় ভিড় জমায় সকলেই। তবে এই টাউন স্টেশনের সংরক্ষণে উদ্যোগী শিলিগুড়ি। বিশ্ব পর্যটন দিবসেও তা দেখা গিয়েছিল স্পষ্ট। অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের (Association for Conservation and Tourism - ACT) আহ্বায়ক (Convenor) তথা পর্যটন বিশেষজ্ঞ রাজ বসু নিউজ ১৮ লোকালকে (News 18 Local) বলেন, 'পঞ্চমী থেকে অষ্টমী অবদি এখনও ঢাকিরা পুরোনো স্টেশনে আসেন। এখন যে জায়গায় শেড (shade) রয়েছে, সেখানে বাজার বসত। কলকাতা থেকে ট্রেন এসে ওখানে দাঁড়াত।
ওখান থেকে পাহাড় ও চা বাগান থেকে সবাই জিনিসপত্র ডেলিভারি (delivery) নেওয়ার জন্য বসত। আগের দিন থেকেই সবাই স্টেশনে অপেক্ষা করত। পুজোর আগে মালপত্র নিয়ে যে যার জায়গায় চলে যেত। তখন এই কানেক্টিভিটি (connectivity) ছিল গোল্ডেন কানেক্টিভিটি (Golden connectivity)।
এভাবেই সেই ট্র্যাক (track) তৈরি হয়েছিল। তবে আগে যেভাবে এই স্টেশনে পুজো হত, সেটা অনেকটা ঝিমিয়ে গিয়েছে। আগে রীতিমত রমরমা কারবার ছিল পুজো ঘিরে। কিন্তু এখন সেই কমিটিও নেই, তেমন উৎসাহও নেই।'
ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে রাজবাবু বলেন, 'মহানন্দা ক্লাবের (Mahananda club ) ওখানে এখনও রেলওয়ে কমপ্লেক্স রয়েছে। শহর ছড়িয়ে ছিল এই কানেক্টিভিটি (connectivity)। তবে বর্ধমান রোড যেটাকে আমরা বলি, সেটা বানিয়েছিলেন বর্ধমান মহারাজা।
টাউন স্টেশনকে ঘিরে একটা জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তাঁদের জন্য রিক্রিয়েশনাল ক্লাব (recreational club), সিনেমা হল, টেনিস কোর্ট (tennis court) ইত্যাদিও গড়ে উঠেছিল। এবং এই স্টেশন চত্বরই শহর ও নগরোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম উন্নত হয়।
এরপর উন্নত হয় এর পশ্চিম দিকের বাজারটি। তারপর গোডাউন। ধীরে ধীরে এর পিছু নিয়ে গোটা শহরকে "শহর" বানানোর চেষ্টা শুরু হয়। এভাবেই শিলিগুড়ির উন্নয়ন শুরু হয়। তখনকার রেলকর্মীদের রমরমা ভাব, বাজারে লেনদেন, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের সমাগমে এই টাউন স্টেশনের পুজো হয়ে উঠেছিল উত্তরবঙ্গের সবেচেয়ে বড় পুজো।'
পর্যটন দিবসের দুদিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন বারবার স্টেশন সংস্কার করার কথা তুলে ধরেছিলেন পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত সদস্যরা। রাজবাবু জানান অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের (Association for Conservation and Tourism - ACT) শুধুমাত্র রুরাল ডেভেলপমেন্ট (rural development) নয়, হেরিটেজ (heritage) বাঁচানোর ও সংরক্ষণের জন্যও কাজ করে।
টাউন স্টেশন নিয়ে ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এখানকার ইতিহাস অজানা নয়। তবে দেখাশোনার অভাবে ধুঁকছে টাউন স্টেশন। এবার আমরা অবশ্যই এই বহু পুরোনো স্টেশনকে হেরিটেজ (heritage) তকমা দিতে চাই। তাই আমরা পুরোদমে কাজও শুরু করে দিয়েছি। ঢাকিদের ইতিহাসের কথা আমরা সকলেই জানি। এখানকার রাস্তা থেকে শুরু করে স্টেশন চত্বর, সবকিছুই পরিষ্কার এবং সংরক্ষণ করব আমরা।'
তিনি আরও বলেন, 'কাউকে ভারতবর্ষ অথবা দেশ চেনাতে হলে আমরা হেরিটেজ (heritage) হিসেবে তাজমহলকে দেখাই। ঠিক তেমনই শিলিগুড়ির জন্য কিন্তু শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন। তাই এটাকে সংরক্ষণ করা বা তকমা দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশ থেকে প্রায় ৭০০ ই-মেল (email) এসেছে, যে এই কাজ ভালো। সত্যি যে টাউন স্টেশনকে সংরক্ষণ করা উচিত তাতে তাঁরা সহমত পোষন করেছেন।'
তবে ঢাকিদের আশ্রয় হোক কিংবা গৌরব ও ইতিহাস বহনকারী স্টেশন হোক। টাউন স্টেশন শিলিগুড়িবাসীর মনেপ্রাণে জায়গা করেই থাকবে।
ভাস্কর চক্রবর্তী