তাঁদের গবেষণা প্রাকৃতিক চাষে ফলন কতটা নির্ভেজাল হয়, পাশাপাশি ভারতের মত কৃষি প্রধান দেশে কেন মহিলা চাষির সংখ্যা কম প্রভৃতি। শান্তিনিকেতনের অদূরে রূপপুর গ্রামে তাদের মাটির বাড়ি, চাষের জমি, পুকুর পাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত-সহ বিদেশ থেকেও আগ্রহী পড়ুয়ারা আসেন৷
চাষে উৎপাদিত ফসল বিক্রি ও পাঠদান থেকে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই সাবলীল জীবন কাটান একদা প্রবাসী এই দম্পতি, দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত। বর্ধমান জেলার বাসিন্দা দেবলবাবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। চাকরি পান আমেরিকার কেন্টাকি শহরে একটি বহুজাতিক সংস্থায়।
advertisement
অন্যদিকে, কলকাতার বাসিন্দা অপরাজিতা দেবী প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমেরিকার কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে সেখানেই পড়ানো শুরু করেন।খাদ্যদ্রব্যে কেন স্বাদ কম, খাদ্যে ভেজালে পরিমাণ বাড়ছে প্রভৃতি ভাবিয়ে তোলে এই দম্পতিকে। আমেরিকার একাধিক গ্রাম ঘুরে সেগুলোই উপলব্ধি করতে থাকেন দেবল-অপরাজিতা৷ এরপরেই হঠাৎ সিদ্ধান্ত। আমেরিকার বিলাশবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে মাটির টানে, দেশের টানে ফিরে আসবেন। চাকরি জীবনের জমানো টাকা থেকে শান্তিনিকেতনের অদূরে রূপপুর গ্রামে পুকুর-সহ সাড়ে ৫ বিঘা জমি কিনে শুরু করেন চাষ নিয়ে গবেষণা।
আরও পড়ুন: ৫০ বছর ধরে মিষ্টিমুখের কারিগর, শিবুদার দোকানে রসগোল্লা খেতে উপচে পড়ে ভিড়
ফার্মাকালচার কোর্স করেন দুজনেই।রাসায়নিক সার ব্যবহারে ফসল ফললেও তার স্বাদ, গুণাবলি প্রভৃতি একেবারেই থাকেনা। উপরন্তু, কীটনাশক ব্যবহারে ক্ষতি হয় মানবদেহে৷ এছাড়া, ভারতবর্ষের মত কৃষি প্রধান দেশে মহিলা চাষির সংখ্যা কম৷ মহিলারা চাষের কাজে অংশ নেন। কিন্তু, মহিলাদের নামে জমি না থাকায় তাদের চাষি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এই নিয়েই মূলত গবেষণা এই দম্পতির।
এমনকী, অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত-সহ বাংলাদেশ, আমেরিকার, ফ্রান্স, সুইডেন প্রভৃতি দেশ থেকে আগ্রহী পড়ুয়া তাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে থেকে প্রাকৃতিক চাষ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও হাতে-কলমে গবেষণায় অংশ নিয়ে গিয়েছেন। এমনকি, ফার্মাকালচার নিয়ে পড়ানোর জন্য সাম্মানিক অধ্যাপক হিসাবে ভারতের বিভিন্ন কৃষি প্রতিষ্ঠান, সেমিনার-সহ নেপাল, বাংলাদেশ, আমেরিকা থেকে ডাক পেয়েছেন এই দম্পতি।
মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি একটি বাড়িতে তাদের বসবাস। বর্তমানে তাদের খামারে ৭ রকমের দেশি ধান, ডাল, গম, বিভিন্ন রকমের লেবু, আম, আতা, পেয়ারা, করমচা, সফেদা, কামরাঙা প্রভৃতি চাষ হয়। পাশাপাশি, মাছ, হাঁসের ডিম উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত ফসল নিজেরা খান, এছাড়া জ্যাম-জেলি প্রভৃতি তৈরি করে বিক্রি করেন। উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে এক কন্যা সন্তান-সহ এই দম্পতির দিনযাপন হয়।
আমেরিকার বিশালবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে দেশের টানে, মাটির টানে চাষে মন দিয়ে মাটির বাড়িতে থেকে স্বচ্ছল জীবন কাটানো যে যায়, তারই উদাহরণ বহন করেন একদা প্রবাসী এই দম্পতি। নিজেদের পড়াশোনার বিষয়কে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে প্রাকৃতিক চাষ ও মহিলাদের চাষে আগ্রহী করে তোলার বিষয়টি তাদের কাছে মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত বলেন, “ক্রমশ বিশ্ব এক উলটো পথে হাঁটছে। খাবারে বিষ দিচ্ছি, হাওয়া দূষিত হয়ে উঠছে, মহিলারা চাষের কাজ করলেও ভারতে তাদের নামে জমি কম। তাই মহিলারা চাষি হিসাব স্বীকৃতি পায় না। এসব নিয়ে আমরা না ভেবে বাড়ি-গাড়ি কেনাকাটায় মন দিই বেশি। আমরা আমেরিকায় স্থানীয় খাবারের বিষয়ে ভাবা শুরু করি। তারপরেই সিদ্ধান্ত নিই। সব কিছু ছেড়ে এখানে চলে আসা। নিজেরা প্রতি মুহুর্তে ভুল করতে করতে শিখি, অপরকেও শেখাই৷ এভাবেই সাবলীল ভাবে আমাদের দিন কেটে যায়।”
Subhadip Pal