A Nabob in Delhi: বইয়ের নির্বাচিত এক অংশ: ‘দিল্লির এক নবাব’
- Published by:Siddhartha Sarkar
- trending desk
Last Updated:
১৭৭২ সালের শেষ দিক। দিল্লির পথে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে তিন ব্রেটন। তাঁদের গন্তব্য হল কিল্লা-ই-মুয়াল্লা। রাজ দরবারে সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে দেখা করবেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন জমকালো পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী, গ্রেনেডিয়ার, প্রহরী এবং সম্ভ্রান্ত মুঘল পরিবারের কয়েকজন ধনী ব্যক্তি। তাঁরা রয়েছেন হাতির পিঠে।
কলকাতা: ১৭৭২ সালের শেষ দিক। দিল্লির পথে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে তিন ব্রেটন। তাঁদের গন্তব্য হল কিল্লা-ই-মুয়াল্লা। রাজ দরবারে সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে দেখা করবেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন জমকালো পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী, গ্রেনেডিয়ার, প্রহরী এবং সম্ভ্রান্ত মুঘল পরিবারের কয়েকজন ধনী ব্যক্তি। তাঁরা রয়েছেন হাতির পিঠে।
একটি হাতির পিঠে বসেছেন পঞ্চাশ বছর বয়সী পার্সি সেনাপতি মির্জা নাজাফ খান। সম্প্রতি মুঘল সাম্রাজ্রের মীর বকশি পদে পদোন্নতি হয়েছে তাঁর। তাঁর পাশেই আরেকটি হাতির পিঠে রয়েছেন সামরিক পোশাকে সজ্জিত রেনে ম্যাডেক। তাঁর চোখেমুখে বিস্ময়। ঘোর যেন কাটতে চাইছে না।
advertisement
advertisement
এসবের মধ্যেই এক ব্রেটন গর্ব করে বলে ওঠে, “অবশেষে ভারতের রাজধানীতে প্রবেশ করলাম। সম্রাটের লোক বা প্রজা হিসেবে নয়। একেবারে সম্রাটের মতো।’’ একসময় নোংরা পরিবেশে নিদারুণ দারিদ্র্যে কেটেছে তার। আজ সে কেউকেটা হয়েছে। দিল্লির কেল্লার নহবত খানার সামনে হাতির পিঠ থেকে নামে সে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে সানাই। জানানো হয় অভিবাদন।
advertisement

মার্বেল পথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন ম্যাডেক। চারপাশে সাজানো বাগান। সেখানে মৃত সম্রাটদের কবর। সম্রাটের কন্যাদের কবরও রয়েছে। কয়েক পা অন্তর মার্বেলের তৈরি ফোয়ারা। বাগানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন দরবারের অনেকে। ম্যাডেক এসে থামলেন দিওয়ান-ই-খাসের সামনে। সেখানে সম্রাটের সাক্ষাৎলাভের জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছেন। তাঁদের মধ্যে ম্যাডেক ছাড়াও রয়েছেন তাঁর সহকর্মী ড্যানিয়েল ডু জার্ডেকও। মুঘলদের মতো পোশাক পরে আছেন তিনি। যেন ছদ্মবেশ ধরেছেন। ম্যাডেকের পাশে দাঁড়িয়ে আরেক ব্রেটোন অফিসার ডি কারসকাও। রিইউনিয়ন দ্বীপের ফরাসি উপনিবেশের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
advertisement
অবশেষে রাজ দরবারে উপস্থিত হলেন সম্রাট। সাধারণ কাঠের সিংহাসনে আসীন। সেই সিংহাসন বয়ে আনছেন চার প্রহরী। আগে রয়েছে রক্ষীরা। তাঁদের হাতে শক্ত লাঠি। মাটিতে লাঠিগুলো ঠুকছেন আর উচ্চস্বরে সম্রাটের আগমন ঘোষণা করছেন তাঁরা। দরবার শুরু হতেই সম্রাট শাহ আলমকে ৭টি রৌপ্য মুদ্রা নজরানা দিলেন ম্যাডেক। তাঁকে দেওয়া হল খিল্লাত। সম্রাটের সামনেই তাঁকে সেটা পরিয়ে দেওয়া হল। এরপর এক ফরাসির কাছে নিজের তলোয়ার পেশ করলেন সম্রাট। ম্যাডেক লিখেছেন, “এটা স্বপ্ন নয়, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’’ সম্রাটের আচরণে মুগ্ধ তিনি। ম্যাডেককে একটি উপাধিও দেওয়া হয়। যার বলে তিনি নিজেকে নবাব বা নবোব বলতে পারবেন।
advertisement
বক্সারের যুদ্ধে সুজাকে হারানোর পর থেকেই হিন্দুস্তানে ম্যাডেকের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। প্রশিক্ষিত ৪০০ সৈন্য নিয়ে তিনি রোহিলা এবং জাটদেরও হারিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ম্যাডেকের দক্ষতা এবং বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। এই সময়ই মারি অ্যান বারবেট নামের এক কমবয়সী তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন ম্যাডেক। কয়েকদিন ধরে চলেছিল সেই অনুষ্ঠান। প্রতিদিন ১০০০ লোককে খাওয়ানো হত। তবে বিয়ের পর কনের প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে ম্যাডেকের। আফশোস করে তিনি লিখেছেন, “স্থানীয় ঐতিহ্যই মেনে চলে এই দেশের ক্যাথলিকরা। কনের মুখ দেখে বিয়ের পর… ফলে কেউ কেউ দেখে র্যাচেলের বদলে লিয়া পেয়েছে।’’ প্রতিকৃতিতে দেখা যায়, মারি অ্যান বারবেট বোঁচা নাক, গোলগাল চেহারার এক মহিলা, যাঁর অপরূপ মুখশ্রী। এর পরে এক মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করেন ম্যাডেক।
advertisement
একদিন চন্দননগরের ফরাসি ট্রেডিং পোস্টের গভর্নরের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ডাক আসে ম্যাডেকের কাছে। ততদিনে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে তাঁর নামডাক ছড়িয়েছে। গভর্নর জিন ব্যাপটিস্ট শেভালিয়ারকে ‘মনেপ্রাণে দেশপ্রেমিক’-এর মর্যাদা দিয়েছেন এক নামকরা ফরাসি ইতিহাসবিদ। শুধু তাই নয়, তাঁকে বলা হয়েছে ‘স্বপ্নের মানুষ’। ভারতের মাটিতে ফরাসি ভাষা পুনরুদ্ধারের জন্য ফ্রান্সে চিঠি লিখে তদ্বির করেছিলেন তিনি।
advertisement
শাহ আলমকে দিল্লিতে পুনর্বহালের খবর পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন শেভালিয়ার। সম্রাটের আশপাশে ফরাসি শক্তি বাড়ানোর কথা ভাবেন তিনি। শেভালিয়ার মনে করেছিলেন, বাংলায় ব্রিটিশদের শক্তি ক্রমশ বাড়ছে। শাহ আলমকে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্রিটিশদের উপর হামলা করবেন। সেই লক্ষ্যে শেভালিয়ার প্রথমে ভার্সাইতে ৪ হাজার সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেন। তাঁরা ম্যাডেকের অধীনে মুঘল সম্রাটকে বাংলা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে। কিন্তু ফরাসি সরকার শেভালিয়ারের দাবিকে আমল দেয়নি। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সম্রাটের পক্ষে স্বাধীন ফরাসিদের এককাট্টা করতে হবে। তবে ফ্রান্স থেকে এজেন্ট পাঠানো হয়। সধারণ মানুষের ছদ্মবেশে তৎকালীন মহীশূর, হায়দরাবাদ, লখনউ এবং দিল্লির আশপাশের এলাকায় ঘুরেঘুরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য।
তবে ইংরেজরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছিল এই সময়। ১৭৭৩ সালে বাংলার সিলেক্ট কমিটি দেখে কোষাগার থেকে ২ মিলিয়ন পাউন্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে স্থানীয় ইআইসি কর্মীদের মধ্যে উপহার হিসেবে বিতরণ করার জন্য। এই পুরো টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোম্পানির কাজকর্মে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বাংলায়। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ক্লাইভ বলেছিলেন, বাংলার জনগণের কী হচ্ছে সেটা তাঁর দেখার বিষয় নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীরা তাঁর কাছে সবার আগে। দুর্ভিক্ষের ফলে ৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। দেউলিয়া হতে বসে কোম্পানি। তখন চা আইন পাস করিয়ে উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে বাংলাকে সাহায্য করা যায়। এই ঘটনায় ক্ষোভ জন্মায় আমেরিকাবাসীর মধ্যে। কয়েক বছরের মধ্যেই তা স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে যায়। ইআইসি আমেরিকার মাটিতে বাঙালির রক্তের ঋণ পরিশোধ করে।
এদিকে ভারতে শেভালিয়ার ম্যাডেকের সমর্থন চেয়ে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ম্যাডেকের মন গলাতে বলছেন, “স্বদেশিদের মধ্যে নিজের সুনাম অর্জন করার থেকে বড় আর কিছু হতে পারে না। আপনি আমার সঙ্গে যোগ দিন।’’ কিন্তু বাস্তববাদী ম্যাডেক রাজি হলেন না। তাঁর টাকা চাই। ম্যাডেক সরাসরি বলে দিলেন, “আমি ইউরোপে ফিরে যেতে চাই। এসবের মধ্যে নেই।’’ কিন্তু শেভালিয়ার নাছোড়, “আপনি সাহসী। আপনাকেই তো এগিয়ে আসতে হবে। হিন্দুস্তানের রাজপুত্ররা আপনাকে পাশে চায়। আপনিই বিপ্লব আনতে পারেন। শেষ পর্যন্ত রাজি হন ম্যাডেক। শেভালিয়ারকে বলেন, “এই মহান উদ্যোগে আপনার সঙ্গে আছি। ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আপাতত বিসর্জন দিলাম। কথা দিচ্ছি, ফরাসি সরকার যদি বাংলা দখলের সিদ্ধান্ত নেয়, আমি নিজের খরচে দশ হাজার লোক নিয়ে সৈন্যদলের সঙ্গে যোগ দেব।’’
এরপরই মুঘল সম্রাটের দরবারে হাজির হন রেনে ম্যাডেক। সম্ভ্রান্ত মুঘলদের মতো দাড়ি রাখেন। পোলো এবং তিরন্দাজির মতো খেলাতেও অংশ নিতেন। দরবারের সমস্ত অনুষ্ঠানেই অংশ নিতেন ম্যাডেক। উট বা হরিণের লড়াই থেকে আতশবাজি পোড়ানো, এমনকী কবিতা প্রতিযোগিতাতেও দেখা যেত তাঁকে। মুঘল সম্রাটের সঙ্গেও অল্প সময়ে ঘনিষ্ঠতা হয় ম্যাডেকের। শেভালিয়ারের উৎসাহে ফ্রান্সের রাজার কাছে এই নিয়ে চিঠি পাঠাতে সম্মত হন ম্যাডেক। মুঘল সম্রাটের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু সম্রাটের বিশেষ কিছু করার ছিল না। সেই সময় দিল্লিতে প্রত্যেক রাজাই স্বাধীন বাহিনী তৈরি করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে নাজাফ খানকে দিল্লির আশপাশের অঞ্চল পুনরুদ্ধারের ভার দেওয়া হয় যেগুলো রোহিলা ও জাটরা দখল করে নিয়েছিল।
Location :
Kolkata,West Bengal
First Published :
July 24, 2024 3:27 PM IST