#নয়াদিল্লি: বাচ্চা থেকে বুড়ো,করোনায় রেহাই নেই কারও। বছর ঘুরতেই ফের গোটা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মারণ করোনাভাইরাস। প্রথমে ডেল্টা (Delta),তার পর ডেল্টা প্লাস (Delta Plus) এবার পালা ওমিক্রন প্রজাতির (Omicron), সঙ্গী ইহু (IHU)। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এবার লেগেছে দু'বছরের কমবয়সী শিশুদের শরীরে। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী মহল। এবার কি তাহলে রেহাই নেই দুগ্ধপোষ্য শিশুরও? সেই দুশ্চিন্তাই ক্রমশ ভাবাচ্ছে গবেষকদের। কিন্তু কেনই বা দু' বছরের কম বয়সি দুগ্ধপোষ্যরা সংক্রমিত হচ্ছে মারণ করোনাভাইরাসে? কী ভাবে তা প্রতিহত করা সম্ভব? পাশাপাশি শিশুদের শরীরে কোভিডের মারাত্মক দিকগুলিই বা কি?
আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা
সম্প্রতি মুম্বই চলচ্চিত্র জগতের টিভি সিরিয়াল-খ্যাত অভিনেতা কিশওয়ার মারচেন্ট (Kishwer Merchantt) সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন, তাঁর চার মাস বয়সী ছেলে নির্ভাইর (Nirvair) কোভিড পজিটিভ (covid plus)। নির্ভাইর আক্রান্ত হয়েছে করোনাভাইরাসে। আক্রান্তের তালিকা এখানেই শেষ নয়। বেশ লম্বা। তার মাত্র কয়েকদিন পরেই নকুল মেহতা (Nakuul Mehta) ও তাঁর স্ত্রী জানকী পারেখ (Jankee Parekh) জানিয়েছেন যে তাদের ১১ মাস বয়সী শিশু সুফি (Sufi) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পর পর শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। দিন কয়েকের মধ্যেই হু-হু করে শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি সুপার স্প্রেডার ওমিক্রনে।
সম্প্রতি আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স-এর (AAP) তরফ থেকে একটি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেই তথ্যে জানানো হয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা সংক্রমিতের মধ্যে ১৭.৪ শতাংশ শিশু। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতি ১ লক্ষ শিশুর মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১১,২৫৫ জন।
আরও পড়ুন :নতুন ভ্যারিয়ান্ট না ল্যাবরেটরির ভুল? ডেল্টাক্রন নিয়ে যা জানা দরকার...
তবে এই প্রথমবার নয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গতবছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীনই শিশুদের সংক্রমিত বা আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছে।
গত ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সমীক্ষা রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার শিশুর শরীরে বাসা বেঁধেছে কোভিড। গত দু'সপ্তাহ আগেই যে সংখ্যাটি ছিল ৩ লক্ষ ২৫ হাজার। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত দু'সপ্তাহে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার ৭৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন : ভারতে করোনার কোন কোন প্রজাতি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাদের উপসর্গ কী কী?
শিশুদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক আঘাত নিয়ে আসতে পারে?
গত বছর জুন মাসে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী শিশুদের থেকে বয়স্কদের ক্ষেত্রে করোনা বেশি মারাত্মক। কারণ হিসাবে সেই রিপোর্টে জানানো হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে কম গুরুতর রোগ রয়েছে। এমনকী করোনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংক্রমণ কখনও উপসর্গবিহীন আবার কখনও লক্ষণগত ভাব রয়েছে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা এও জানিয়েছেন, সুস্থ শিশুর শরীরে মাঝারি কিংবা গুরুতর করোনা সংক্রমিত হওয়া একপ্রকার অস্বাভাবিক। আক্রান্ত হওয়া শিশুদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শিশুদেরই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন রয়েছে বলে জানানো হয়েছে ওই রিপোর্টে।
কোভিডে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সংক্রমিত হওয়া শিশুদের মধ্যে আগে থেকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া শিশুদেরই মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তাদের শরীরে আগে থেকেই বাসা বেঁধে রয়েছে জটিল রোগ। তারা বলেছেন যে মাল্টি-ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম(MIS)নামক একটি বিরল অবস্থার কারণে শিশুদের মৃত্যু ঘটতে পারে,যেখানে একাধিক অঙ্গে প্রদাহ বা মারাত্মক জ্বালাপোড়া থাকে।
আরও পড়ুন : ই-পাসপোর্ট কী, কবে ভারতে চালু হতে পারে এই ব্যবস্থা?
করোনায় লক্ষণ ভিন্ন হওয়ার শিশুদের প্রতি কী ধরনের আচরণ হওয়া উচিত?
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে কোভিডের লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় শিশুদের প্রতি আচরণ ভিন্ন হওয়া উচিত। কারণ হিসাবে তাঁরা জানিয়েছেন, শিশুদের মধ্যে করোনার লক্ষণ ও উপসর্গগুলি মূলত দৃশ্যমান নয়। শিশুরা কখন এই রোগে আক্রান্ত হয় তা সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। কারণ কোভিডের সর্দি লাগা মূলত শিশুদের মধ্যে লেগে থাকা সাধারণ সর্দি জ্বরের মতো। তাই মোটের ওপর বোঝায় যায় না যে শিশুরা ঠিক কখন এই রোগে সংক্রমিত হচ্ছে। পাশাপাশি তারা এও বলেছেন, প্রাপ্তবয়স্করা বেশি পরিমাণে করোনায় সংক্রমিত হলেও বর্তমানে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগের।
আরও পড়ুন : করোনাকে জব্দ করছে আমাদেরই শরীরের টি কোষ, দাবি নতুন গবেষণায়
দেখে নেওয়া যাক শিশুদের মধ্যে করোনার সাধারণ উপসর্গগুলি কী কী?
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)এবং ইউনিসেফ-এর (UNICEF) তরফ থেকে জানানো হয়েছে, হাই ফিভার তিনদিনের বেশি স্থায়ী হওয়া,পাশাপাশি শিশুর খাওয়া কমে যাওয়া, অলসতা, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা গেলে একজন ডাক্তারের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করা উচিত।
এমনকী, সদ্যোজাত থেকে দু'মাস বয়সী শিশুদের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতি মিনিটে ষাট বার শ্বাসের উপরে হলে একজন চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ঠিক একইভাবে যদি ২-১২ মাস এবং ১২-৫৯ মাসের মধ্যে বাচ্চাদের প্রতি মিনিটে শ্বাস-প্রশ্বাস ৫০ এবং ৪০ বারের উপরে থাকে তবে ওই শিশুকে চিকিৎসকের কাছে অবশ্যই নিতে হবে বলে জানানো হয়েছে।
শিশুদের মধ্যে আরও কী উপসর্গ দেখা দিতে পারে?
ইউনিসেফ-এর তরফ থেকে আরও জানানো হয়েছে, যে বাচ্চাদের মধ্যে আরও কিছু উপসর্গ দেখা গেলে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করা উচিত। যেমন শিশুর বুকে ঘড়ঘড়ে শব্দ হওয়া, ক্রমশ ফ্যাকাশে বা নীল হয়ে যাওয়া, ঠাণ্ডা বোধ করা, চোখ বসে যাওয়া এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাবে খুব একটা না যাওয়া, খেতে অস্বীকার করা, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবের পাশাপাশি শিশুর গুরুতর ডায়রিয়া, বমি বা পেটে ব্যথার মতো উপসর্গ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
ওমিক্রন শিশুদের ক্ষেত্রে কতটা মারাত্মক?
করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি ওমিক্রন শিশুদের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকারক, এ বিষয়ে অবশ্য চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ মহলে ভিন্ন মত রয়েছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে ওমিক্রনে শিশুর ম্রত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আবার অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন শিশুদের মধ্যে বয়স্কদের তুলনায় ইমিউনিটি বেশি হওয়ায় এই রোগ তারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম। পাশাপাশি চিকিৎসকরা এও জানিয়েছেন, বয়স্কদের থেকে শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেশি এবং সংবেদনশীল হওয়ার কারণে বাতাস থেকে সহজেই শিশুরা সংক্রমিত হতে পারে। এই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন তারা। তবে শিশুদের তুলনায় বয়স্কদের ওমিক্রনে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও মার্কিন মুলুকে শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেনি বলে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
শিশুকে কী ভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে?
এ বিষয়ে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কোভিড চলাকালীন বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া। মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই তা বিশেষ প্রয়োজন। চিকিৎসায় গাফিলতি হওয়া উচিৎ নয়। হাত এবং শ্বাস প্রশ্বাসের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বাচ্চার প্রতি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষিত থাকতে মাস্ক পরতে হবে, নিয়মিত মাস্ক পরিষ্কার করার পাশাপাশি সেগুলি পরিবর্তন করতে হবে একেবারে নিয়ম করে।
আক্রান্ত শিশুর খাবারের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে হবে। ওই সময় শিশুকে কোন বিশেষ খাদ্য দিতে হবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে।
কোভিড আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই বাড়িতে রান্না করা খাবার খাওয়াতে হবে এবং ভালোভাবে হাইড্রেটেড রাখতে হবে। এছাড়াও শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন C, জিঙ্ক, ভিটামিন D, ক্যালসিয়ামের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে একেবারে নিয়ম করে।
ইতিমধ্যেই কোভিডে আক্রান্ত শিশুর নাম নথিভুক্তকরণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতার গাইড লাইন দেওয়া হয়েছে সরকারি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির মাধ্যমে। সে দিকেও নজর রাখা বিশেষ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Coronavirus, Kids, Omicron