#কলকাতা: সম্প্রতি আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)। জো বাইডেন (Joe Biden), কমলা হ্যারিসের (Kamala Harris) সঙ্গে বৈঠক করেছেন, রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশনে (UNGC) ভাষণ দিয়েছেন তিনি। তবে খালি হাতে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরেননি। ফিরে আসার সময় বেশ কিছু উপহার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ভারত থেকে চুরি যাওয়া বা চোরাচালান হিসেবে আমেরিকায় পাচার হয়ে যাওয়া ১৫৭টি শিল্পকর্ম (Artefacts) ও পুরাকীর্তি (Antiquitie) দেশে ফিরিয়ে এনেছেন।
১৫৭টি শিল্পকর্মের মধ্যে দশম সাধারণ যুগের বালি পাথরের তৈরি দেড় মিটারের রেবন্ত, দ্বাদশ সাধারণ যুগের সাড়ে ৮ সেন্টিমিটারের ব্রোঞ্জের নটরাজ রয়েছে। বেশির ভাগ সমগ্রী একাদশ থেকে চতুর্দশ সাধারণ যুগের। এছাড়াও তামার একটি পুরাকীর্তিও রয়েছে। যেটি প্রাক সাধারণ যুগের ২০০০ বছর আগেকার ঐতিহাসিক নিদর্শন। দ্বিতীয় সাধারণ যুগের টেরাকোটার ফুলদানি সহ প্রাক সাধারণ যুগের ৪৫টি পুরাকীর্তিও আছে। ৭১টি শিল্পকর্ম সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সামগ্রীর নিদর্শন। বাকিগুলির মধ্যে হিন্দু ধর্মের ৬০টি, বৌদ্ধ ধর্মের ১৬টি এবং জৈন ধর্মের ৯টি নিদর্শন আছে। পুরাকীর্তিগুলি ধাতু, পাথর এবং টেরাকোটার। লক্ষ্মী-নারায়ণ, বুদ্ধ, বিষ্ণু, শিব-পার্বতী এবং ২৪ জন জৈন তীর্থঙ্করের সুসজ্জিত মূর্তিগুলি মূলত ব্রোঞ্জের তৈরি।
এছাড়াও কঙ্কোলা মূর্তি, ব্রাহ্মী এবং নন্দীকেশর স্বল্প পরিচিত মূর্তিও রয়েছে। এগুলি ছাড়া অনামী দেব -দেবীর মূর্তিও এই তালিকায় আছে। হিন্দু ধর্মের (তিন মাথার ব্রহ্ম মূর্তি, রথে উপবিষ্ট সূর্য, বিষ্ণু এবং তার পারিষদ, দক্ষিণমূর্তি হিসেবে শিব, নৃত্যরত গণেশ ইত্যাদি), বৌদ্ধ ধর্মের (দণ্ডায়মান বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী, তারা) এবং জৈন ধর্মের (জৈন তীর্থঙ্কর, পদ্মাসন তীর্থঙ্কর, জৈন চৌবিসি) মূর্তিগুলি ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন মূর্তিও রয়েছে। সেগুলি হল- সমভঙ্গ অবস্থায় নিরাকার দম্পতি, চৌরি বহনকারী, বাদ্যযন্ত্র সহ মহিলারা ইত্যাদি। ৫৬টি টেরাকোটার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় সাধারণ যুগের একটি ফুলদানি, দ্বাদশ সাধারণ যুগের একজোড়া হরিণ, চতুর্দশ সাধারণ যুগের নারী মূর্তি। এছাড়াও পার্সিতে লেখা গুরু হরগোবিন্দ সিং-এর (Guru Gobind Singh) নামাঙ্কিত খাপ সহ তলোয়ার এই তালিকায় রয়েছে।
সরকারের তরফে বলা হয়েছে, শিল্পকর্ম ও পুরাকীর্তিগুলি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে আসার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার নিরলস চেষ্টা চালাচ্ছে। পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের চুরি, বেআইনি বাণিজ্য ও পাচার রোধে সম্মত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও নরেন্দ্র মোদি। এই ক্ষেত্রে দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। আমরিকার আগে জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়াও ভারত থেকে চুরি যাওয়া অনেক প্রত্নসামগ্রী ফিরিয়ে দিয়েছে। আসলে পশ্চিমা দেশগুলিতে জাদুঘর এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এমন অনেক জিনিস আছে যা আদতে ভারতের সম্পত্তি। এখনও এমন হাজার হাজার প্রাচীন সামগ্রী রয়েছে যা পশ্চিমা সংগ্রাহকদের দখলে রয়েছে, আর সেগুলি প্রত্যাবর্তনের জন্য কোনও স্পষ্ট রোডম্যাপ নেই।
চোরাচালান হওয়া প্রত্নসামগ্রী বা পুরাকীর্তি ফেরত আনার জন্য কোনও আইন আছে কি?
বেশ কয়েক দশক আগে ইউনেস্কো (Unesco) ঘোষণা করে যে সাংস্কৃতিক সম্পত্তির চুরি, লুটপাট এবং অবৈধ পাচার একটি অপরাধ। কারণ এটি তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক সমন্বয়কে দুর্বল করে। এই চোরাচালান রোধ করতে রাষ্ট্রসংঘের এই সংস্থা ১৯৭০ সালে সাংস্কৃতিক সম্পত্তির বেআইনি আমদানি, রফতানি এবং হস্তান্তর রোধে কনভেনশন নিয়ে এসেছিল। যা দেশগুলিকে সাংস্কৃতিক সম্পত্তির অবৈধ পাচার রোধে ক্ষমতা দিয়েছিল। যাই হোক, এই ১৯৭০ সালের কনভেনশন সাংস্কৃতিক সম্পত্তির অবৈধ চোরাচালান রোধে, হারিয়ে যাওয়া প্রত্নসম্পদ দেশে ফেরানোর প্রশ্নে খুব বেশি কাজে লাগে না।
সাংস্কৃতিক সম্পত্তির ফেরানোর সম্পর্কে ইউনেস্কো বলেছে যে এই সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত ১৯৭০ সালের কনভেনশনের অধীনে হওয়া উচিত। যাতে বলা হয়েছে যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেই সাংস্কৃতিক সম্পত্তি ফেরানো উচিত। তবে, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলস্বরূপ অথবা কনভেনশন লাগু হওয়ার আগে চোরাচালান হওয়া সাংস্কৃতিক সম্পত্তি ফেরত নেওয়ার বিষয়ে কোনও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নেই। তবে, ইউনেস্কো ১৯৭৮ সালে আন্তঃসরকার কমিটি (Intergovernmental Committee for Promoting the Return of Cultural Property) গঠন করেছিল। এই কমিটির কাজ হল সাংস্কৃতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সহজতর করা। যার অর্থ এটা যে এই বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত পৌঁছনো দুই দেশের উপর নির্ভর করে। এবং সেখানেই কাজটা কঠিন হয়ে যায়।
এখানে কী কী বাধা আসছে?
পশ্চিমা দেশগুলি অবৈধভাবে তাদের দখলে থাকা প্রাচীন সামগ্রীর উপর মূল দেশগুলির অধিকারের বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার কথা বলেছে, এই জাতীয় সামগ্রীর ফেরানোর বিষয়ে যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন মত তাদের। রিপোর্ট বলছে, যখন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে (David Cameron) জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তাঁর দেশ কোহিনূর হিরে ( Koh-i-noor Diamond) ফেরত দেবে কি না, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি এই ধরনের 'রিটার্নিজম' সমর্থন করেন না। কারণ, তাতে ব্রিটিশ জাদুঘর খালি হয়ে যাবে। ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনে আইন রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে পাবলিক কালেকশনের অংশ হিসেবে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর মালিকানা হস্তান্তর করা যায় না। তার ফলে এক্ষেত্রে চোরাচালানের ফলে এই দুই দেশে যাওয়া প্রত্ন সামগ্রী ফেরত পাওয়া অসম্ভব।
ভারত কী ভাবে পুরাকীর্তিগুলি ফিরিয়ে আনছে?
চলতি বছরের মার্চ মাসে সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক (Union Culture Ministry) বলেছিল যে গত পাঁচ বছরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা থেকে ৩৫৫টি পুরাকীর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। মন্ত্রক বলেছে যে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে (Archaeological Survey of India) পুরাকীর্তি ফেরত আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং আমেরিকা, সুইৎজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে, এতে কত সময় লাগবে তা জানায়নি মন্ত্রক। প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যসম্পন্ন এই সব ভাস্কর্য ফেরত পাওয়ার পর একটি বিবৃতি জারি করেছে ভারত সরকার। তাতে দাবি করা হয়েছে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে চুরি যাওয়া মাত্র ১৩টি প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করা গিয়েছিল। তবে, ২০১৪-২০২১ সালের মধ্যে এমন ২০০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিদেশ থেকে দেশে ফেরানো হয়েছে।
সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সস অ্যান্ড কাস্টমস-এর (Central Board of Indirect Taxes & Customs) প্রাক্তন চেয়ারম্যান নজিব শাহ জানিয়েছেন যে কম্পেট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল-এর ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে এএসআই-এর এই সংক্রান্ত কাজ পরিচালনার জন্য কোনও নীতিমালা ছিল না। এছাড়াও পুরাকীর্তির মোট সংখ্যার কেন্দ্রীয় ডেটাবেসও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। তিনি বলেন, "বিদেশে থাকা ভারতের পুরাসামগ্রীর সন্ধান ও তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি হল বিদ্যমান এবং চুরি হওয়া পুরাকীর্তি এবং প্রত্নসম্পদের একটি শক্তিশালী ডেটাবেস তৈরি করা।"
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Narendra Modi