সুধীর কুমার সেন। যিনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার প্রায়ই যাতায়াত ছিল ইউরোপ, জার্মানিতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলন চলার সময় সঙ্গ দিয়েছিল প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বিধানচন্দ্র রায়ের। সেই স্বদেশী আন্দোলনের সময় ইউরোপের রালে সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে তিনি ভারতবাসীকে পরিচয় করিয়েছিলেন সাইকেলের সঙ্গে। এই সাইকেল হয়ে উঠেছিল কর্মব্যস্ত ভারতবাসীর যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম প্রথমদিকে ১৯১২ সালে হাজার খানেক সাইকেল তিনি রপ্তানি করেন ইউরোপ থেকে। ভারতবাসীকে পরিচয় করান সাইকেলের সঙ্গে। পরবর্তী ক্ষেত্রে সুধীর কুমার সেন রালে সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এনে এদেশের মাটিতেই শুরু করেন সাইকেল প্রস্তুতি। ধীরে ধীরে ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাইকেল। তখন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে সেন রালে বাইসাইকেল কারখানা। অবিভক্ত ভারতবর্ষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেন রালে সাইকেল। তারপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিধানচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় আসানসোলের কন্যাপুর গড়ে ওঠে সম্পূর্ণভাবে দেশের মাটিতে তৈরি সাইকেল কারখানা। সেন রালের আকার, বিক্রি আরও বৃদ্ধি পায়। সাইকেলের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় সাইকেল বিক্রি সংখ্যা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারত ছাড়াও, বাংলাদেশ এবং আশপাশের দেশগুলিতে এই সাইকেল রপ্তানি করত এই সংস্থা।
advertisement
আরও পড়ুন - জামাইষষ্ঠীর আগেই ফল-মিষ্টির আগুন দাম! কমবে কি দাম? কি বলছে বাজার? জানুন
কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী থাকা এই সংস্থা আজ চলে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়েছে সুধীর কুমার সেন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিধানচন্দ্র রায়ের স্মৃতি বিজড়িত এই সেন রালে সাইকেল ফ্যাক্টরি। শুরুর পর থেকেই সাইকেল ফ্যাক্টরির আকার-আকৃতি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে চাহিদা, উৎপাদন। কিন্তু কালের নিয়মে আস্তে আস্তে শুরু হয় কারখানার অবক্ষয়। ১৯৭৫ সালে এই কারখানার দায়িত্বভার গ্রহণ করে ভারত সরকার। সংস্থার নাম পরিবর্তন করা হয়। নাম হয় সাইকেল কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। কিন্তু রুগ্ন অবস্থা থেকে হাল ফেরানো যায় না এই সংস্থার। অবশেষে ২০০৩ সালে পুরোপুরিভাবেই সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই ভারতের প্রথম সাইকেল উৎপাদনকারী সংস্থার বাজার কাঁপানো সমস্ত মডেলগুলি হারিয়ে যেতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস হয়ে যেতে শুরু করে কারখানা থেকে শুরু করে কারখানার অধীনে থাকা বিপুল সম্পত্তি।
আরও পড়ুন - আসানসোলে ভবতারিণী মন্দিরের পাশেই হল হনুমান মন্দির, কলস যাত্রায় আজ প্রাণপ্রতিষ্ঠা
সংস্থার প্রাক্তন কর্মচারী এবং ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে জানা যায়, সেন রালে সংস্থায় একটা সময় চার হাজারের বেশি কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন স্থায়ী কর্মচারীর পাশাপাশি বহু শ্রমিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করতেন। আসানসোলের কন্যাপুরের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল কারখানা এবং তার বিপুল সম্পত্তি। কারখানার পাশাপাশি ছিল কর্তৃপক্ষের প্রায় ৭০০ কোয়ার্টার। তৈরি হয়েছিল সেন রালে ক্লাব, সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কারখানা বন্ধ হওয়ার পর, সময় যত এগিয়েছে, ততই সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আজ কারখানা চত্বরে শুধুই আগাছার জঙ্গল। কোথাও কোথাও রুগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু-একটি ইটের দেওয়াল। কিছু কিছু পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে এখনও প্রাক্তন কর্মীরা বসবাস করেন। কিন্তু চোখের সামনে ইতিহাসের সাক্ষী থাকা কারখানাকে, ইতিহাস হতে দেখার আক্ষেপ তারা এখনও ভুলতে পারেন নি। সংস্থার বাজার কাঁপানো হাম্বার, রবিনহুড মডেলগুলিকে স্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তারা।
Nayan Ghosh