ধর্মমঙ্গল কাহিনীকে বাদ দিলেও ময়না গড়ের বয়স কিন্তু কম নয়। কলিঙ্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত 'জলৌতি দণ্ডপাট' এর অধিকারী ছিল বাহুবলিন্দ্র রাজপরিবারের পূর্ব পুরুষেরা। পর্যন্ত 'জলৌতি দণ্ডপাট' এর রাজধানী ছিল বালিসিতা গড়। এই বালিসীতা গড় থেকেই ১৫৬১ সালে বাহুবলীন্দ্র রাজপরিবারের পূর্বপুরুষ গোবর্ধননন্দ বাহুবলীন্দ্র প্রথম ময়না গড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। যা আজও মানুষের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ময়নার গড়ের অন্দরে রয়েছে অনেকগুলি দর্শনীয় স্থান। প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন শিব মন্দির লোকেশ্বর জিউর মন্দির। এখানে শিবলিঙ্গের অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক নিচে। নদীর জোয়ারের সময় শিবলিঙ্গ উপরে উঠে আসে। এই মন্দিরের সঙ্গে কাঁসাই নদীর সংযোগ রয়েছে।
advertisement
আজও কাঁসাই নদীর জোয়ারের সময় শিবলিঙ্গ উপরে উঠে আসে আবার ভাটার সময় নিচে চলে যায়। পাশেই আছে রঙ্কিনী দেবীর মূর্তি। এক হাজার বছরের প্রাচীন মূর্তি। সারাবছরের নিত্য পূজার পাশাপাশি। দুর্গাপূজার সময় বিশেষ পূজা হয় এই চারদিন। ময়না গড়ের অন্দরে রয়েছে কুল দেবতা শ্যামসুন্দর জিউর মন্দির। প্রতিদিন নিত্য হয়। প্রতিদিন কাঠের উনুনে ভোগ রান্না সম্পন্ন হয়। ময়নাগড়ের ভেতর দেবতার কাহিনীর পাশাপাশি অপ দেবতার কাহিনী লোকমুখে শোনা যায়। লোকের বিশ্বাস প্রাচীন তেঁতুল গাছে একসময় ব্রহ্মদৈত্য থাকত। আজও তেঁতুল গাছের তলায় দাঁড়াতে গা ছমছম করে বৈকি।
পুরনো রাজবাড়ি, রাজদরবার কাছারিবাড়ি, গুপ্ত ঘর এসবের পাশাপাশি রয়েছে ২০০ বছরের প্রাচীন কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল গাছের বর্তমানে কান্ড খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শ্যামসুন্দর জিউর মন্দিরের পাশে রয়েছে এই কাঁঠাল গাছ। ইতিহাস প্রতি পদক্ষেপে কথা বলে ময়নাগড়ে। দুর্গটি প্রায় দুর্ভেদ্য ছিল দুটি পরিখার অবস্থানের জন্য। পরিখার গভীরতা অনেক, তাতে ছাড়া থাকত হিংস্র কুমীর। ছিল সর্পসংকুল পদ্মবন। এই দহ সাক্ষী থেকেছে বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়াসের (১৭৪০ থেকে ১৭৪৪)। ইংরেজরাও দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছে ময়নাগড় দখলের। ওয়ারেন হেস্টিংস এক সময় আদেশ দিয়েছিলেন পরিখা বুজিয়ে ফেলার, যদিও তা কার্যকর হয়নি।
এখনও ময়নাগড়ে যাবার জন্য নৌকাই ভরসা। সকাল নটা থেকে বারোটা অবধি নৌকা চলে। তার বাইরে কোনো সময় যেতে হলে পুরো নৌকা ভাড়া করতে হবে। ময়নাগড়ে এখনো বাহুবলীন্দ্র পরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন, তাঁদের সবারই ব্যক্তিগত নৌকা এবং ঘাট আছে। জীবনযাপনের যাবতীয় প্রয়োজনের জন্য নৌকাই একমাত্র উপায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পানীয় জলও আসত নৌকাবাহিত হয়ে। এমনকি মৃত্যুর পর সৎকারকার্যের জন্য কালিদহ পার হয়ে শবদেহ আনতে হয় দুই পরিখার সংযোগস্থলে মাটি কেটে বানানো রাজপরিবারের শ্মশানভূমিতে। এখন ১৭০ ফুট প্রশস্ত কালিদহে ঝুঁকে থাকে শ্যামল ছায়াময় গাছ, নীল আকাশ, রাজহাঁসের সারি।
কল্পনাও করা যায় না, এখানেই রাজদ্রোহী প্রজাকে কুমীরের মুখে ছুঁড়ে ফেলা হত একসময়। রাজপরিবারে নববধূ এলে তাঁকে পালকি শুদ্ধ পরিখার জলে চুবিয়ে শুদ্ধ করে রাজবাড়িতে তোলা হত। এবং যে সদ্য বিবাহিত মেয়েটি কালিদহ পার করে একবার ময়নাগড়ে পা রাখত, তার আর কোনওদিন বেরোবার নিয়ম ছিল না। আমৃত্যু থাকতে হত অন্তঃপুরবাসিনী বন্দিনী হয়ে। দ্বীপের মধ্যে দুর্গ, তা থেকেই নাম ময়নাগড় বা ময়নাচৌরা। চৌরা শব্দটির উড়িয়া ভাষায় অর্থ জলবেষ্টিত ভূখণ্ড। উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থানের জন্য এটি দূর থেকে দেখা গেলেও প্রবেশের কোনও উপায় ছিল না।
আরও পড়ুনঃ শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের অবস্থা বেহাল! অভিযোগ করেও হয়নি সুরাহা
চারপাশে ছিল হিংস্র শ্বাপদসংকুল জঙ্গল যার দুর্ভেদ্য কাঁটা বাঁশ বন এখনো খানিকটা দেখা যায়। বিভিন্ন উঁচু জায়গায় বসানো থাকত কামান, ছিল পাঁচিলের মত উঁচু ঢিপি। ইংরেজ সৈন্য সে সব অতিক্রম করে ময়নায় প্রবেশ করলেও তৎকালীন রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রকে জীবন্ত ধরতে পারেনি। কিছু বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করেন জগদানন্দ, জীবদ্দশায় আর সেই গুপ্ত কুঠুরি থেকে বের হননি তিনি। জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রের স্মৃতিস্তম্ভ, হাওয়ামহল, আয়নামহল, রাজদরবার কক্ষ।
আরও পড়ুনঃ ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে প্রধান শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়ে বিশেষ কর্মশালা
এখানে রাজাদের শিকারের নিদর্শন রূপে গোলাকার থামের গায়ে টাঙানো আছে হরিণের মাথা। দেওয়ালে নানা আকারের কুলুঙ্গি, যাতে জ্বলত প্রদীপ। রয়েছে একটি সিন্দুক, যা আজও খোলা যায়নি। এখান থেকেই নীচে ভূগর্ভে যাওয়ার পথ ছিল, যা এখন নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ। তবে ময়নাগড়ে বেড়াতে এলে একটা কথা মনে রাখবেন হেরিটেজ স্বীকৃতি পেলেও ময়নাগড়ে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই আসার আগে রাজ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন আগে থেকেই।
Saikat Shee