নদিয়ার শান্তিপুরের তাঁত শিল্প জগৎ বিখ্যাত। সেখানেই বাড়ি হওয়ার সুবাদে এবং নিজের কাজের জন্য মান্ডবী চক্রবর্তী মাঝেমধ্যেই এই শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতে যেতেন। তাঁদের বিপন্নতার কথাও এই সূত্রেই জানতে পারেন। হঠাৎ তাঁর মাথায় পরিকল্পনা আসে, নিজের আঁকা তাঁতের শাড়ির উপর ফুটিয়ে তুললে কেমন হয়। দু-একজন শিল্পীকে দিয়ে সেই কাজ করেন। এরপর সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন। দ্রুত এই ধরনের তাঁতের কাজ শাড়ি প্রেমীদের নজর কেড়ে নেয়। সেই শুরু।
advertisement
বর্তমানে ২২ জন সুদক্ষ তাঁতিকে নিয়ে মান্ডবী বিশেষ উদ্যোগ শুরু করেছে। এর ফলে নতুন করে জীবন পেয়েছেন শান্তিপুরের তাঁত শিল্পীরা। সারাদিনে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারছেন তাঁরা। মান্ডবী যে শাড়ি তৈরি করেন তার বাজার মূল্য ৩-৪ হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত হয়। এখনও পর্যন্ত একটি শাড়ি পিছু সর্বাধিক ৮০ হাজার টাকা মজুরি পেয়েছেন। যদিও তা তৈরি করতে সাত-আট মাস সময় লেগেছে।
আরও পড়ুন: বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ পান সপ্তাহ পালন
শাড়ির উপর পুরনো বিভিন্ন ধরনের নকশা, লতাপাতা, ফুল এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে মান্ডবী বিভিন্ন পোর্ট্রেটের কাজ করেন। শ্রীকৃষ্ণের ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সমস্ত পর্যায়, শারদীয়া আগমনের বিভিন্ন চিত্র, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে সিনেমার উদ্ধৃতি সহ অসাধারণ হাতের কাজ, হাঁদাভোদা, নন্টে ফন্টে, অরণ্যদেব, টিন টিনের মতো কমিক্সের বেশ কিছু আকর্ষণীয় সিরিজ, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গান, বিখ্যাত গল্প উপন্যাসের বহুল প্রচলিত অংশ, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, ভ্যানগগের স্টারি নাইট আরও কত কী এই বধূর হাত ধরে ফুটে উঠছে তাঁতের শাড়িতে!
প্রথমে তিনি নিজে ছবি আঁকেন। এরপর তাঁতির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তা রূপ নেয় ১২ হাত শাড়িতে। তবে এই শিল্পকর্ম এখন শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নেই। কুর্তি, ধুতি, স্কার্ফ, ওড়না, ঘর সাজানোর সামগ্রীতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শৌখিন ঢাকনায় পর্যন্ত বিস্তারিত হয়েছে। মটকা, রেশম, কটন, তসর, স্টান সিল্ক, লিলেন এ ধরনের নানান উপকরণ পার্শ্ববর্তী ফুলিয়াতে পেলেও গুণগত মান বজায় রাখতে মাঝেমধ্যে তা অন্যান্য রাজ্য থেকেও আনেন মান্ডবী।
আরও পড়ুন: ৪০ ঊর্ধ্ব খেলোয়াড়দের নিয়ে আট দলীয় নকআউট ফুটবল প্রতিযোগিতা নদিয়ায়
তবে তার উৎপাদিত পণ্যের কোনও আউটলেট বা দোকান নেই। বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার, নামি দামি কোম্পানি, হস্তশিল্পের গবেষক ছাত্রছাত্রীরাই মূলত তার ক্রেতা। কোনও শাড়ি বুনতে সাত দিন সময় লাগে, কোনটা আবার এক মাস। এমনকি কিছু বিশেষ ধরনের নকশার শাড়ি বুনতে ৬ মাস সময় লেগেছে এমনটাও আছে।
একসময় নদিয়ার শান্তিপুরের প্রত্যেক গ্রাম এবং শহর এলাকায় মানুষের ঘুম ভাঙতো হস্ত চালিত তাঁতের খটখটানিতে। প্রতিটি বাড়িই প্রায় কারখানাতে রূপান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক মেশিনের রমরমার ফলে হস্তাচালিত তাঁতের সেই দিন গিয়েছে। তবে মন্ডবীদেবীর সৃষ্টিশীলতা ও অভিনব ভাবনার হাত ধরে আবার সুদিন ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মৈনাক দেবনাথ





