সম্প্রতি শিলিগুড়িতে করোনা ভ্যাকসিন নিতেই শরীরে নাকি পয়সা, হাতা, খুন্তি, চামচ সমেত যেকোনও ধাতব বস্তু এমনকি মোবাইলও আটকে যাচ্ছে বলে খবর চাউর হয়। সেই 'ম্যাগনেট ম্যান' হলেন নেপাল চক্রবর্তী। নেপালবাবু একপ্রকার 'ফেমাস' এখন! ইন্টারনেট সেনসেশন যাকে বলে আর কি! তবে নেপালবাবু চৌম্বকীয় শক্তির তত্ত্বকে নস্যাৎ করলেন চিকিৎসক মহল। শিলিগুড়ির বিশিষ্ট ডাক্তার তথা কনসালটেন্ট জিআই এবং ল্যাপারোস্কপিক সিনিয়র সার্জেন ডাঃ কৌশিক ভট্টাচার্য এবিষয়ে বলেন, 'এসব ম্যাগনেট ম্যান-সুপারম্যান-স্পাইডারম্যানের তত্ত্বের সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোন সম্পর্ক নেই। ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাকরণ সম্পূর্ণ একটি আলাদা বিষয়। কোভিডের জন্য যে সমস্ত টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে মানব শরীরে, যার ফাস্ট এবং সেকেন্ড ডোজে হঠাৎ করে চুম্বকীয় শক্তির উদ্ভাবন সঙ্গে সম্পর্কহীন। তবে বিষয়টিকে একেবারেই নাকচকরাও যায় না। বিষয়টি পরীক্ষামূলক তদন্তসাপেক্ষ বলেই মনে করি।'
advertisement
এদিকে, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডিন ডাঃ সন্দীপ কুমার সেনগুপ্ত বলেন, 'আমি আশ্চর্য না হলেও এরকম কোনও ঘটনা শুনিনি। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছিলাম যে একটি মানুষ টিউবলাইটের দু'ধারে ধারে স্পর্শ মাত্রই টিউবলাইটটি জ্বলে ওঠে। তবে সম্প্রতি এই ধরনের ঘটনায় ছেয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। আদতেকিছু মানুষএকজনের ভাইরালদেখে নিজের উপর সেই পরীক্ষা করতে গিয়েই এইধরনের মনগড়া গল্প রটাচ্ছেন।' তিনি বলেন, 'বলা হচ্ছে কোভিড ভ্যাকসিনের থেকে এই ধরনের ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। তাহলে এই বিষয়ে বলে রাখা ভালো, টিকাকরণ শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ। তারপর থেকে প্রায় ২৪ কোটি মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। ২২ কোটির কাছাকাছি কোভিশিল্ড পেয়েছেন, আর ২ কোটির একটু বেশি কোভ্যাক্সিন। তাহলে শুরুথেকে কোন অভিযোগ কেউ করলেন না কেন। কাজেই ভ্যাকসিনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। তবুও বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।'
কোভিড ভ্যাকসিনে এহেন কোনও রসায়ন আছে যা দিয়ে চৌম্বকীয় শক্তির সৃষ্টি হতে পারে মানব শরীরে প্রশ্ন সন্দীপবাবুকে করা হলে তিনি বলেন, 'আমরা চিকিৎসকরা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে কোন রসায়ন আছে বলে কোনও তথ্য আছে বলে শুনিনি। তবে, ল্যানসেটে একটি পাবলিকেশন আছে যেখানে দেখা গেছে ডিএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সুপার প্যারাম্যাগনেটিক আইরন-অক্সাইড ন্যানো পার্টিকেল সিস্টেম অর্থাৎ স্পাইয়ন রয়েছে। সেখানে খুব সামান্য পরিমাণে যদিও ভ্যাকসিন খুব সামান্য ডোজে দেওয়া হয় তাতে যদি ন্যানোপার্টিকেল থাকেও সেটাতে যে শরীরে চুম্বকীয় শক্তির সৃষ্টি করবে তা একেবারেই ভুল। অন্যদিকে আরএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এধরনের তথ্য একেবারেই শুনিনি। তাও পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখতে চাইব ভ্যাকসিন থেকে এহেন ঘটনা ঘটার কথা নয়।'
শরীরের ভেতরে কোন কৃত্রিম যন্ত্র থাকলে কী এরকম ঘটনা ঘটা সম্ভব সন্দীপবাবুকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আমার সঠিক জানা নেই। তবে একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই অনেক কিছুই তো প্রথম হয়। এক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন পথ অবশিষ্ট নেই। পাশাপাশি আমি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা করে চলেছি। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। তবে এরম ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্টই কম। সেইসঙ্গে শিলিগুড়ির বাসিন্দা নেপাল চক্রবর্তী যাঁর শরীরে এই চৌম্বকীয় শক্তি রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তাকেও আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে। যাতে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে আদতেও এরকম কোন ঘটনা ঘটছে কি না। তবে তিনি এখনও পর্যন্ত কোনও সদুত্তর দেননি। পাশাপাশি বলে রাখা ভালো কারোর শরীরে যদি আর্টিফিশিয়াল প্লেট বা প্রেসমেকার বসানো থাকে তাঁরা যদি কোনো ম্যাগনেটিক ফিল্ডে বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন তখন যন্ত্রের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কঠিন পরিস্থিতিতে দেহের অন্তর্বর্তী যন্ত্রটি খারাপ হয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ পেসমেকার থাকলে শরীরে এমআরআইনা করানোর পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। কিন্তু সেক্ষেত্রে শরীরে চৌম্বকীয় শক্তির সৃষ্টি একেবারেই হয় না।'
ক্রমশ চাউর হওয়াএই ম্যাগনেট ম্যানের ভিডিও মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এই আতঙ্ক না সরালে মানুষ ভ্যাকসিন বিমুখী হবে। তাই সর্বসাধারণকে আশ্বাস দিয়ে ডাঃ সেনগুপ্ত বলেন, 'কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে যেমন ডাবল মাস্কিংয়ের প্রয়োজন, সামাজিক দূরত্ববিধি মানার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ভ্যাকসিনের। কাজেই কোনওভাবে ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাকরণ প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার মতো ঘটনাকে আমাদেরসু্যোগ করে দেওয়া উচিত নয়। মানুষকে আরও বেশি সজাগ, সচেতন ও চিন্তনশীল হতেই হবে। তবেই আমরা এই মারণ ব্যাধির থেকে রেহাই পেতে পারব। অন্যথা সমস্যার সমাধানের জায়গায় বড় কোনও আরেক সমস্যা উদয় হতে পারে।'
Vaskar Chakraborty