বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।' রবি ঠাকুরের কথাই আজ যেন সত্য। শিলিগুড়ি শহর। দুই জেলা নিয়ে বহর ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিলিগুড়ি। কিছুটা জলপাইগুড়ি জেলা, কিছুটা আবার দার্জিলিং। চারিদিকে প্রচুর সীমানা-সীমান্ত। 'চিকেনস নেক' নামটা এমনি এমনি পাওয়া নয়! তবে এই চিকেনস নেকেরও এই সীমানায় রয়েছে অনেক অজানা তথ্য, অনেক বিবাদ। কিছু স্থানীয় এই জায়গায় চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করেন, কেউ আবার অবৈধভাবেই কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে চলে আসেন আরেক প্রান্তে। জলপাইগুড়ি জেলার প্রচুর জায়গা এমন রয়েছে যেখানে রাতের অন্ধকারেই পাচার হয় মাদক থেকে শুরু করে গরু। কেউ ধরা পড়ে, কেউ আবার বেঁচে যায় এই যাত্রায়। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অথবা বিএসএফ সর্বক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে নজরদারি! কিন্তু তারাও এবার চাইছে সুরক্ষা আরও মজবুত হোক, আরও নিরাপত্তায় মুড়ে যাক সীমান্তবর্তী এলাকা।
advertisement
উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলির প্রায় দেড়শো গজ জমি ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জমিতেই। সেই এলাকায় ভারতীয়রা চাষাবাদ করছেন। কেউ আবার থাকছেন সেখানেই। এককথায় 'নো ম্যানস ল্যান্ড' বলা চলে সেই জমিগুলোকে। কারণ, সেখানে নেই কারও মালিকানা অথবা কারও একার অধিকার। এবিষয়ে বিএসএফের হাজার পরিকল্পনা রয়েছে। এনিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা থেকে বৈঠক, সবই প্রায় শেষ। কিন্তু জমি বিবাদ নিয়ে শেষমেষ কিছুই হচ্ছে না। অন্যদিকে, জলপাইগুড়ির জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু জানান, এই বিষয়টি জেলা প্রশাসনের হাতে নেই। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে তবেই এর সমাধান হবে।
শিলিগুড়ি তথা জলপাইগুড়ির অধিকাংশ এলাকা সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে নিরাপত্তা নিয়ে তৎপর বিএসএফ তথা প্রশাসন। তবে কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর দিয়ে অবাধে যাতায়াত রোখা চারটিখানি কথা নয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় অনেকেই ধরা পড়েছে ইতিমধ্যেই।
ভূমি রাজস্ব দপ্তর সূত্রে খবর, শিলিগুড়ি-দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত তিনটি ব্লকে মোট ২৬টি মৌজা রয়েছে; যা সরাসরি নেপাল ও বাংলাদেশ সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। তিনটি ব্লকের মধ্যে প্রথম ব্লক হল নকশালবাড়ি ব্লক। এর অন্তর্গত সাতটি মৌজা রয়েছে। যেগুলি হল মেচী ফরেস্ট (৩০১২ একর), সুরাজবর ফরেস্ট-১ (৯৯ একর), সুরাজবর ফরেস্ট-২ (৫১০.০৪ একর), বড় মনিরাম (১০৩৯.৩৬ একর), নেহাল (২৫৩.১৩ একর), ছোট মনিরাম (৮৫৮.৮১ একর) এবং ঢাকনা (৬২৪.৫৮ একর)। বলাবাহুল্য এই নকশালবাড়ি ব্লকের সাতটি মৌজা নেপাল বর্ডারের গা ঘেঁষা।
দ্বিতীয় ব্লক হল খড়িবাড়ি ব্লক। যার অন্তর্গত নয়টি মৌজা রয়েছে। যেগুলি হল মদন (২৯২.৪৯ একর), অন্তরাম (৬০৭.৪৫ একর), ভুলকা (৬০৮.০৯ একর), পশ্চিম রামধন (৫৩৮.৩৯ একর), চুনিলাল (৪২৯.৩৫ একর), তরী (৫৮৬.৮২ একর), চিকু (৫৩৫.৯৬ একর), বৈরাগী (৫৬২.৪৫ একর) এবং রংমুনি (২৫৫.২৮ একর) মৌজায় বিস্তৃত। বলাবাহুল্য এই ব্লক অর্থাৎ খড়িবাড়ি ব্লকের প্রতিটি মৌজাই নেপাল সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত।
তৃতীয় অর্থাৎ শেষ ব্লক ফাঁসিদেওয়া। যার অন্তর্গত দশটি মৌজা রয়েছে। যেগুলি হল লালদাস (৪৩৪.০৫ একর), হাতিরাম (৫৩৪.৮৩ একর), লিউসিপুকুড়ি (১৬১৯.৪৮ একর), রুপন দিঘী (৪৯৯.৯০ একর), গুয়াবাড়ী (৫৩৬.১৭ একর), বন্দরগছ (৫২৮.৯৭ একর), পূর্ব বাঁশগাও কিসমত (৫৬৩.৪৫ একর), বাঁশগাও মানগছ (৮৯৫.৬৯ একর), পূর্ব বাঁশগাও (১৫৬০.০৮ একর) এবং পূর্ব বাঁশগাও চাকলা (৩৪২.৩১ একর) মৌজায় বিস্তৃত। বলাবাহুল্য এই ব্লক অর্থাৎ খড়িবাড়ি ব্লকের প্রতিটি মৌজায় বাংলাদেশ সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে থেকে লালদাস মৌজা রাজগঞ্জ ব্লকের ফুলবাড়ির বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা।
অভিযোগ, ফাঁসিদেওয়া ব্লকের দশটি মৌজায় বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিবাদের কারণ নতুন করে আর কিছু নয় সেই 'জমিই'। এলাকার আদি কিছু স্থানীয়দের মতে, এই এলাকায় যেহেতু বাংলাদেশের সন্নিকটে অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় ওই দেশ থেকে প্রশাসনের নাকে ডগার নীচ থেকে অনেকেই রাতের অন্ধকারে এদেশে এসে উঠছে। এবং এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালীদের প্রভাবে এদেশে জমিও পেয়ে যাচ্ছে। তবে কাকতালীয়ভাবে কোনও অভিযোগই এখনও পর্যন্ত যেমন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের কাছে নেই তেমনই সীমান্তে থাকা প্রহরীদের কাছেও নেই।
এ প্রসঙ্গে শিলিগুড়ি (দার্জিলিং) মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের এসআরও-১ আধিকারিক প্রবাল দাশগুপ্ত বলেন, 'সীমান্তবর্তী এলাকায় জমি বিবাদ নিয়ে কোনও তথ্য যেমন নেই, ঠিক তেমন ভাবে কোনও অভিযোগও নেই। একইভাবে শিলিগুড়ি সাব ডিভিশনে তথা জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় ছিটমহল বা নোম্যান্সল্যান্ডেরও তথ্য নেই। তবে কোচবিহার আলিপুরদুয়ার জেলায় থাকলেও থাকতে পারে। মোদ্দাকথা যদি ছিটমহল বা নোম্যান্সল্যান্ড থেকে থাকেও তবে তা অন্য জেলায় থাকলেও থাকতে পারে। আমাদের এখানে নেই।'
সীমান্ত এলাকায় জমি বিবাদ নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রবালবাবু বলেন, 'জমি বিবাদ যদি সীমান্তবর্তী এলাকায় হয়, তবে সেখানে ভূমি সংস্কার দপ্তরের কিছু করার থাকে না। এই দায়িত্ব কিছুটা হলেও সীমান্তে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীদের ওপরই বর্তায়। বিএসএফ এক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করলেও করতে পারে। সেক্ষেত্রে ভূমি সংস্কার দপ্তরের না কিছু করার থাকে, আর না কিছু করার কোনও জায়গা বা অবকাশ থাকে।'
বহু জায়গায় সরকারি জমি অধিগ্রহণ হয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রবালবাবু বলেন, 'একথা ঠিক যে বহু গরীব গৃহহীন মানুষ অনেক সময় নিজের মাথার ওপর একটু ছাদের আশায় সরকারি জমিতে বসবাস করতে শুরু করেন। সরকার বহু সময় এই সমস্ত মানুষদের পাট্টার ব্যবস্থা করেছে। তাদের জন্য বহু প্রকল্প চালু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ নিজ গৃহ নিজ ভূমি, এর মাধ্যমে এই সমস্ত ভূমিহীন গরীব মানুষদের স্থায়ী বসবাসের একটা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাকরণের জন্য সরকার সবসময় সচেষ্ট হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'অতিসম্প্রতি সরকার পুরনো যেসব কলোনী রয়েছে বা উদ্বাস্তু কলোনি রয়েছে সেইসব কলোনির দিকে নজর দিয়েছে। এইসব কলোনীর মধ্যে থাকা দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্ত বসবাসকারী মানুষ রয়েছেন এবং যাদের কাছে সঠিক কাগজপত্র রয়েছে তাদেরকেও পাট্টা করে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছে সরকার।'
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডঃ অরিন্দম বসাক নিউজ ১৮ লোকালকে জানান, জমিবিবাদ স্বাধীনতার সময় থেকেই রয়েছে। এই সমস্যাগুলো মেটাতে বাংলাদেশ সরকার তথা ভারত সরকার তৎপর হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের কেউ এখনও বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, 'উত্তরবঙ্গে আলিপুরদুয়ার জেলার সঙ্গে ভুটানের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা রয়েছে। ১০৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সীমান্ত। কোচবিহার ও বাংলাদেশের সীমান্তরেখা ৩৪২ কিলোমিটার। জলপাইগুড়ি জেলার সঙ্গে দুটো দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ৭৭ কিলোমিটার এবং ভুটানের সঙ্গে ৪২ কিলোমিটার। দার্জিলিং জেলায়েও রয়েছে দুটি দেশের সীমান্তরেখা। বাংলাদেশের সঙ্গে ২০ কিলোমিটার ও নেপালের সঙ্গে রয়েছে ১০০ কিলোমিটারের সীমান্তবর্তী এলাকা।'
তিনি সীমান্তবর্তী এলাকা নিয়ে আরও বলেন, 'উত্তরবঙ্গের প্রত্যেকটা জেলার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক বর্ডার রয়েছে। সবথেকে এখানে বেশি যে সমস্যা দেখা যায়, সেটা হল কাঁটাতারের বেড়ার অভাব। অথবা যথাযথ নিরাপত্তার অভাব। কিছু কিছু জায়গায় থাকলেও সব সীমান্তবর্তী এলাকায় এই নিরাপত্তা নেই। এর ফলে মানুষ খুব সহজেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশ করতে পারে। তাও আবার সম্পূর্ণ সঠিক নথি ছাড়াই।'
উত্তরবঙ্গের ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী খুব সহজেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পা রাখতে পারবে। অরিন্দমবাবু এনিয়ে বলেন, 'সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চাষাবাদ হয়। চা, পাট, ধান চাষ খুব প্রচলিত। জমির উর্বরতা এর অন্যতম কারণ। তবে শুধু চাষাবাদই নয়, এরপর হয় চোরাপথে পাচার।'
সীমান্তবর্তী এলাকায় জমিবিবাদ ছাড়াও রয়েছে অনেক অসুবিধা। স্থানীয়দের যাতায়াতে বাধা, পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য! সবমিলিয়ে সীমান্ত এলাকাগুলি থাকে বিএসএফের কড়া নজরের মধ্যে। তারপরেও অনেক সময় নানা অসুবিধা ও বাকবিতণ্ডায় জড়াতে হয় সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনকে। তবে এসবের পরও কমছে না বিবাদ, কমছে না অবাধে যাতায়াত। রাজ্য প্রশাসনের আগামী নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে বর্ডার প্রশাসন।
ভাস্কর চক্রবর্তী