একদিকে অক্সিজেনের জন্য হন্যে হয়ে এপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আরেকদিকে, তৈরি করতে হচ্ছে অক্সিজেন ব্যাঙ্ক; এমনকি ভাবতে হচ্ছে অক্সিজেন প্ল্যান্টের কথাও। সরকারও যেন \'অতিসক্রিয়\' ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় হয়ত মানবকূলের বোধোদয় হয়েছে। কোথাও বৃক্ষরোপণ অভিযান, তো কোথাও উদ্ভিদ দত্তক নিয়ে প্রকৃতির প্রকোপকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
advertisement
গোটা বিশ্বে প্রকৃতির এই কড়াল রূপ আজ অজানা নেই কারোর কাছে। সমদৃশ্য যেন উত্তরের রাজধানী শিলিগুড়িতেও। ছোট শহর যেখানে রাজনীতির আঙিনাও কখনও এতটা উষ্ণ হয় না যা অতিমারির প্রকোপে হয়েছে। কাউন্সিলর থাকার সময় নিজের ওয়ার্ড নানা ধরনের গাছ দিয়ে সাজিয়েছিলেন তিনি। নিজের বাড়িতে বাগানও পরিচর্যা করেন নিজ হাতেই। এবার পুর প্রশাসকের দায়িত্বে তিনি। আর দায়িত্ব পেয়েই শিলিগুড়ি শহরে ১০ লক্ষ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা শিলিগুড়ি পুরনিগমের বর্তমান প্রশাসক গৌতম দেব।
বৈকুণ্ঠপুর, মহানন্দা বনাঞ্চল দিয়ে ঘেরা হলেও শহর শিলিগুড়িতে গাছের বড় অভাব। জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত সংযোজিত ওয়ার্ডগুলিতে যদিও বা কিছু গাছ রয়েছে, শিলিগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের ৩৩টি ওয়ার্ডে তেমন খুব একটা গাছপালা নেই। তবে বলাবাহুল্য, ব্যতিক্রম শিলিগুড়ির কলেজ পাড়া। গৌতমবাবু এই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা।
১৯৮৯ সালে প্রথম কাউন্সিলর হওয়ার পরে বনমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের ওয়ার্ড গাছ দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিদিন সকালে নিজেই সেই সমস্ত গাছের পরিচর্যা করতেন। এখন তার ফল হাতেনাতে পাচ্ছেন। শিলিগুড়ি শহরের সবচেয়ে সবুজে ভরা ওয়ার্ড এটি। শীতের সকালে নানা পরিযায়ী পাখিও এখানে দেখতে পাওয়া যায়। গাছ ও পাখির টানে গোটা শহর থেকে প্রবীণেরা এই ওয়ার্ডে প্রাতঃভ্রমণে আসেন। এ বার শিলিগুড়ি পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হওয়ার পরে সমগ্র শিলিগুড়ি শহরটিকে গাছ দিয়ে মুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি।
গৌতম দেব বলেন, \'গাছ না-থাকলে সেই শহরকে কী মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য বলা যায়? শিলিগুড়ি শহরে গাছের বড়ই অভাব। সেই অভাব পূরণেই দশ লক্ষ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এত গাছ এক বছরে রোপণ করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, গাছ রোপণ করলেই হয় না, সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই ধাপে ধাপে এই কাজটি করা হবে।\'
লক্ষ লক্ষ গাছের চারা একমাত্র বন দপ্তরের পক্ষেই সরবরাহ করা সম্ভব। ইতিমধ্যেই গৌতমবাবুর এই ব্যাপারে বন দপ্তরের পার্কস অ্যান্ড গার্ডেন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছেন। জুন-জুলাই মাস গাছ লাগানোর মরসুম। বন দপ্তর ওই সময়ে রাজ্য জুড়ে বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজনও করে থাকে। সেই সময়ে শিলিগুড়ি শহরেও গাছ লাগাবে পুরসভা।
সবচেয়ে বেশি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর দুই পাড়ে। সংস্কারের অভাবে হতশ্রী মহানন্দাকে সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। নদীর দুই পাড়ে বাঁধ দিয়ে ভাঙন রোধের ব্যবস্থা হয়েছে। এবার গাছ লাগিয়ে নদীর দু\'পাশে শোভা বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে শহরের স্কুল, কলেজ, সরকারি জমি ও রাস্তার দুই পাশেই গাছ লাগানো হবে।
প্রাক্তন মন্ত্রী বলেন, \'হিলকার্ট রোড, সেবক রোড ও বিধান রোডে রাস্তার পাশে গাছ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য রাস্তাগুলিতেও গাছ লাগানো সম্ভব। গাছের মধ্যে ফুল ও ফলের গাছই প্রাধান্য পাবে।\'
এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ তাপস চট্টোপাধ্যায় বলেন, \'শহরের সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে গাছের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে শহরের বিশেষ কয়েকটি ওয়ার্ডকে তালিকায় রাখা যায়। বাকি ওয়ার্ডে সেই অর্থে উদ্ভিদের দেখা নেই বললেই চলে। তবে করোনাকালে অনেক ক্ষতি হলেও একটি বিষয় নজরকাড়ার মতো। তা হল, বৃক্ষরোপণ। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি শহরের নাগরিকগণ উদ্ভিদ চারা রোপণে এগিয়ে এসেছেন। এই কঠিন সময়ে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয় বলেই মনে করি।\' তাপসবাবু আরও বলেন, \'এই পরিস্থিতিতে শহরের প্রশাসকের এই উদ্যোগ যথেষ্ট আশাপ্রদ। তবে বলে রাখতে চাই সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক এই গাছগুলি রোপণ করেই দায়সারা যাবে না। তাদের প্রতিসময়ে পরিচর্যাও করতে হবে। আশা করছি, মাননীয় প্রশাসক আমাদের শহরের জন্য যা ভেবেছেন, তা যথার্থই।\'
অন্যদিকে, উদ্যান ও কানন বিভাগের উত্তরবঙ্গের ডিএফও অঞ্জন গুহ বলেন, \'গৌতম দেব যখন পর্যটনমন্ত্রীর পদে ছিলেন, তখন তিনি আমায় একবার এই ইচ্ছের কথা বলেছিলেন। আমিও তখন শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। তারপর প্রশাসক হিসেবে তাঁর এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আমার তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা থাকবে। ওঁনার সঙ্গে আলোচনা করে, কীভাবে শহরকে সবুজে ঘেরা যায়, এনিয়ে কাজ শুরু করব।\'
বর্তমানে অক্সিজেনের অভাব শহরজুড়ে। কৃত্রিম উপায়ে মানুষকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এসময় সৌন্দর্যায়নের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অঞ্জনবাবু বলেন, \'শহরাঞ্চলে দাঁড়িয়ে আমরা সৌন্দর্যায়ন বলব না। এটিকে আমরা সবুজায়ন বলতে পারি। শহরকে সবুজে মুড়ে দেওয়া। এতে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণও বাড়ে এবং শহরটি সুন্দর হয়ে যায়।
শিলিগুড়ি শহরের দার্জিলিং মোড় থেকে এয়ারভিউ মোড় পর্যন্ত সারি সারি গাছ সাজানো রয়েছে। কিন্তু মার্কেট থেকে সেবক রোড পর্যন্ত তেমন কোনও গাছের নাম নেই। এমন কোনও গাছ কি আছে যেটা সামান্য পরিচর্যার পর গাছটি নিজেই বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে? এই প্রশ্ন করতেই অঞ্জনবাবু বলে ওঠেন, \'অবশ্যই। এমন গাছ রয়েছে। আমরাও চাই যে রাস্তার পাশে এমন গাছ সারিতে সারিতে লাগানো থাকুক। এই গাছগুলির তেমন পরিচর্যার দরকার পড়ে না। নিমগাছের তেমন পরিচর্যা করতে হয় না। এর অনেক উপকারও রয়েছে। বকুল গাছও সারাবছর সবুজ থাকে। তেমন পরিচর্যার দরকারও পড়ে না। ফলের গাছও লাগানো যেতে পারে।\'
প্রশাসক পদে থাকা গৌতমবাবুর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই অঞ্জনবাবুর উত্তর, \'হ্যাঁ। এনিয়ে কথা হয়েছে। আমরা শীঘ্রই কাজ শুরু করব।\'
ভাস্কর চক্রবর্তী