কলেজে পড়াকালীন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের বিভিন্ন বক্তৃতা তাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বুঝেছিলেন ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে লড়তে সুরেন্দ্রনাথের পথে হাঁটতে হবে। তাই আইন নিয়ে পড়তে নিয়ে বিদেশ যাত্রা করেন। বিদেশযাত্রার তাঁর মায়ের দুটি শর্ত ছিল, এক বিদেশে গিয়ে কোনওদিন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত ছিল কোন মেম সাহেবকে বিয়ে করা যাবে না। মায়ের শর্ত মেনেই ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে বিলেত যাত্রা করেন তিনি। এবং রাখেন মায়ের কথাও৷
advertisement
বিলেত থেকে ফিরে এসে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করা শুরু করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। অল্পদিনেই উকিল হিসেবে নাম যশ ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। কলকাতা হাইকোর্টে বা অন্যান্য জেলার আদালতে স্বদেশী বিপ্লবীদের হয়ে তিনি মামলার লড়াই করতেন। প্রয়োজনে সেইসব স্বদেশীদের আর্থিক সাহায্য তিনি করতেন। সেই সময় গ্রামে-গঞ্জে কলেরা ও বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব প্রচুর ছিল। এছাড়াও বন্যা, খরা, ঝড়ঝঞ্জা প্রভৃতি কারণে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যেতেন। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর মধ্যে কোনও জাত পাত ভেদাভেদ ও কুসংস্কার স্থান পায়নি।
স্বদেশী ও বিপ্লবীদের পীঠস্থান মেদিনীপুর। ইংরেজরা বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে ১৯১৩ সালে মেদিনীপুর জেলাকে দুভাগ করে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। ইংরেজদের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে মেদিনীপুরবাসী। গর্জে ওঠেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার তখনকার মতো বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। কিন্তু ১৯১৯ সালে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নেয় মেদিনীপুর জেলায় ২৩৫ টি ইউনিয়ন বোর্ড তৈরি করার। ইংরেজদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আরও বেশি করে ট্যাক্স আদায় করার। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর নেতৃত্বে শুরু হয় ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিরোধ আন্দোলন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এই আন্দোলনে বীরেন্দ্রনাথ প্রতিজ্ঞা করেন যে, যতদিন না তিনি ইউনিয়ন বোর্ড তুলতে পারবেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি খালি পায়ে ঘুরে বেড়াবেন।
জমিদার বংশের সন্তান, বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার জুতো ছাড়াই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের খারাপ দিক সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তুলে ধরেন। তিনি সাধারণ মানুষকে বোঝান ইংরেজ সরকারকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ হওয়ায় ব্রিটিশ বাহিনী একের পর এক বাড়িঘর লুটপাট করে, সম্পত্তি ক্রোক করে নিলামে তোলে। ইংরেজ বাহিনীর প্রচুর মানুষকে বন্দি বানায়। তবুও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতে পারে না। দিন দিন থানায় বন্দির সংখ্যা ও ক্রোক করা মালের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার ইউনিয়ন বোর্ড গুলি তুলে নেয়। সমস্ত বন্দিদেরকে মুক্তি দেয়। এরপর কাঁথির মাঠে সাধারণ মানুষ জড়ো হয়ে বীরেন্দ্রনাথের পায়ে জুতো পরিয়ে দেয়।
বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কে কংগ্রেস দল তাদের বঙ্গীয় সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের যুবরাজ ভারত ভ্রমণে এলে কংগ্রেস দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। কংগ্রেসের বঙ্গীয় সম্পাদক হিসেবে কলকাতায় হরতাল সংগটিত করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু ও বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে ছ'মাস কারাভোগ করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ফিরে আসেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরের মানুষ তাঁকে দেশপ্রাণ উপাধি ভূষিত করে। দেশপ্রাণ বীরেন্দ্র শাসমল এর জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারত না ইংরেজ সরকার। তাঁর তেজস্বিতাকে সহ্য করতে না পেরে ইংরেজ সরকার ব্ল্যাক বুল (Black Bull) বলত।
১৯২৩ সালে জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইংরেজ সরকার কাজকর্মে বাধা দিত। তা সত্ত্বেও তিনি কয়েকটি প্রাথমিক স্কুল স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পুকুর খনন কার্য করেছিলেন। জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি ইংরেজ সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি দেশবাসীর সেবায় নিয়োজিত এক প্রাণ। এর আগে জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হত ইংরেজ সরকারের মনোনীত কোন ব্যক্তি। যে ইংরেজ সরকারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রথম জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে ইংরেজ সরকাররের বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় তিনি স্বদেশীদের পাশে দাঁড়িয়ে মামলা লড়েছিলেন হাইকোর্টে। মেদিনীপুরের জেলাশাসক ডগলাস হত্যা মামলায় তিনি আসামিদের পক্ষে হয়েই লড়াই করেছিলেন মেদিনীপুর আদালতে। ১৯৩৩ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়ী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সেবার প্রধান অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার কথা ছিল বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের। কিন্তু সেদিন ওই পদে বসানো হয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের প্রতি হয়েছিল অবিচার। এর পরের বছর তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, বিটল ভাই প্যাটেল বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সহ বেশ কয়েকজন কংগ্রেস ছেড়ে স্বরাজ পার্টি গঠন করে। পরে অবশ্য স্বরাজ পার্টি কংগ্রেসে মিশে যায় কঠোর পরিশ্রমের কারণে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ২৪ নভেম্বর ১৯৩৪ সালে মারা যান। তিনি কারাবাসের সময় লিখেছিলেন "স্রোতের তৃণ" নামে আত্মজীবনীমূলক বই। সেই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, "আমি কখনও কারো কাছে মাথা নত করিনি। তাই আমার মৃত্যুর পর আমার মাথা যেন অবনত করা না হয়।" তাই বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে, তাঁর দেহকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দাহ করা হয় কেওড়াতলা শ্মশান ঘাটে। বর্তমানে কাঁথি মহাকুমার একটি ব্লক দেশপ্রাণ নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার একই রাস্তা দেশপ্রাণ নামে নামাঙ্কিত হয়েছে।