পুজো শুরু হওয়ার পিছনে কারণ খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে। দিল্লির সিংহাসনে তখন বসে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব আর বাংলাতেও তখন চলছে নবাবি শাসন। সেই সময় ১৬৬২ সালে বর্তমান রায় চৌধুরী বংশের পূর্বপুরুষ রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী হাওড়ার বেশ কয়েকটি গ্রামের মালিকানা পান মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে। সেই গ্রামগুলির মধ্যে শিবপুরও ছিল। সেই সময় শিবপুরের বর্তমান বাড়িটিতেই বাস ছিল রায় চৌধুরীদের। পূর্বে মুখার্জি পদবি হলেও বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর থেকে রায়চৌধুরী উপাধি পাওয়ার পর থেকেই শতকের পর শতক এই পদবি ব্যবহার করে আসছেন ওই বংশের সদস্যরা। রায়চৌধুরী বাড়িতে দুর্গাপুজা শুরু হওয়ার সঠিক সময় নিয়ে মতভেদ থাকলেও ১৬৮৫ সাল থেকেই পুজো শুরু হয় বলেই মনে করা হয়। রায় চৌধুরী বাড়ির সুপ্রাচীন ঠাকুর দালানটিই তার প্রমাণ।
advertisement
আরও পড়ুন: জলঘড়ি মেনে সন্ধিপুজো, ৫ গ্রামে রিলে সিস্টেমে পৌঁছয় সন্ধির ডাক, গায়ে কাঁটা দেওয়া পুজোর ইতিহাস...
সেই সময়ের অনেক আগে থেকেই রায় চৌধুরীরা মূলত দেবী চণ্ডীর ভক্ত ছিলেন। রাজা রামব্রহ্ম রায় চৌধুরীর শিশুকন্যা প্রতিদিন বাড়ি সংলগ্ন বাগানটিতে তার বন্ধু পদ্মাবতীর সঙ্গে খেলত। যদিও সেই পদ্মাবতীকে জমিদারবাড়ির কেউই কখনও দেখেনি। প্রতিদিনই নিজের কন্যার মুখ থেকে তার বন্ধু পদ্মাবতীর সম্পর্কে নানান গল্প শুনে রামব্রহ্মের একদিন ইচ্ছা হলো পদ্মাবতীর সাথে দেখা করার। রামব্রহ্ম তার কন্যাকে পদ্মাবতীকে একদিন জমিদারবাড়িতে নিয়ে আসতে বললে সে জানায়, পদ্মা কারও বাড়িতে হঠাৎ করে যায় না। তার যেখানে যখন ইচ্ছা সে সেখানেই যায়। মেয়ের কথা শুনে এবার জেদ চেপে যায় রামব্রহ্মের। মেয়ের খেলার ফাঁকে একদিন তিনি নিজেই হানা দেন পদ্মাকে দেখতে। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছনোর আগেই পদ্মা সেই স্থান ছেড়ে চলে যায়। আদতে পদ্মা বলে কেউই নেই বলে ভেবে নেন রামব্রহ্ম। কিন্তু বাগানের নরম মাটিতে পায়ের ছাপ তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে। এই ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পান না রামব্রহ্মবাবু।
আরও পড়ুন: ৩০০ বছরের হাঁসখালির গাজনা হরিতলার মহিলা পরিচালিত পুজো, প্রতিমা গড়েন মহিলারাই
সেইদিন রাতেই স্বপ্নে তিনি জানতে পারেন তার কন্যার বন্ধু পদ্মাবতী আসলে আর কেউই নন বরং দেবী দুর্গা। মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই বছর থেকেই শুরু হয় শিবপুরের রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। এখনও সেই প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই দুর্গাপূজা হয় সাঁঝের আটচালায়। পুজোর আগে কৃষ্ণনবমী তিথি থেকেই শুরু হয়ে যায় রায়চৌধুরী বাড়ির দেবী দুর্গার আবাহন। প্রাচীন অলংকার ও সাজসজ্জায় সেজ ওঠে দুর্গা প্রতিমা। ধূপ-ধুনোর গন্ধে ম - ম করে ওঠে রায়চৌধুরীদের বনেদি বাড়ি।
যদিও ওই সময় মা দুর্গার প্রতিমার সামনে কোনও ঘট রাখা হয় না। বেলগৃহে বোধনের ঘট প্রতিষ্ঠা হয় বোধনের সন্ধ্যেবেলা। সেইস্থানেই চলে মূল পুজো। সেই সঙ্গে পুজো উৎসর্গ করা হয় বেতাইচণ্ডী মা ও মা কালীকেও। আগে দুর্গাপুজোতে প্রায় প্রতিদিনই আট থেকে নটি করে পশুর বলি দেওয়া হতো রায় চৌধুরী বাড়িতে। শোনা যায় প্রবল ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য সাদা ছাগকেও বলি দেওয়া হতো সাঁঝের আটচালায়। যদিও বর্তমানে পুজোর সবদিন মিলিয়ে পুজোয় মাত্র চারটি ছাগবলি দেওয়া হয় মাকে উৎসর্গ করে।
বিসর্জনের আগে মা দুর্গার মাথা থেকে মুকুটটি খুলে পরিয়ে দেওয়া হয় রায়চৌধুরীদের গৃহদেবী মা বেতাইচণ্ডীর মাথায়। বিসর্জনের ক্ষেত্রে পূর্বে প্রতিমা বাড়ির ছেলেদের কাঁধে চেপে গঙ্গাবক্ষের দিকে রওনা দিলেও বর্তমানে লোকবলের অভাবে ট্রলি করেই গঙ্গায় দিকে যাত্রা করেন দেবী দুর্গা । যদিও বিসর্জনের আগে মাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করানোর নিয়ম নেই রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোয় ।
আসবেন কিভাবে?
কলকাতা হাওড়া থেকে যে কোনো বাসে নবান্নর পরের স্টপেজ মন্দিরতলা তারপর টোটো বা রিক্সায় উঠে পড়ে " সাঁঝের আটচালা" বললেই এসে পড়বেন রায় চৌধুরীদের দুর্গাপুজায়। ঠিকানা- ৪৬এ/১১, শিবপুর রোড, শিবপুর হাওড়া - ৭১১১০২।
Santanu Chakraborty






