তখন ১৯৫০ সাল। সদ্য সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে ভারতবাসী। তখন থেকেই পথচলা পাল চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোর। স্বর্গীয় নিত্যগোপাল পাল চৌধুরী এই পুজো (Durga puja 2021)শুরু করেন। সহযোগিতা করতেন তাঁর স্ত্রী স্বর্গীয় সুনিতিবালা পাল চৌধুরী। ১৯৭০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে ২০১১ পর্যন্ত দীর্ঘদিন পুজোর দায়িত্ব পালন করেন রঞ্জিত পাল চৌধুরী।
advertisement
মণ্ডপের দায়িত্বে থাকতেন পরিবারের সদস্য স্বর্গীয় শ্রী মানিক ঘোষ মহাশয় এবং বাড়ির মেজো ছেলে শ্রী অশোক পাল চৌধুরী। এছাড়াও বাড়ির বড়ো জামাই স্বর্গীয় ক্ষিতিশ রঞ্জন গুপ্ত অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছিলেন বাড়ির পুজোকে। তাঁদের অবর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে পুজোর (Durga puja 2021)দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিপ্লব পাল চৌধুরী এবং স্বপন পাল চৌধুরী।
২০২১-এ পুজোর দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছেন সায়ন্তন পাল চৌধুরী। সায়ন্তনবাবু নিউজ ১৮ লোকালকে (News 18 Local) বলেন, 'জেঠু ও বাবার তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।' দুর্গাপুজোর সময় যেন এই বাড়ির রূপ পালটে যায়। বাড়ির সকলে এক তো হয়ই, সঙ্গে জমে প্রতিবেশীদের ভিড়। এই সময় সদস্য সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৫০-৬০!
এই পুজোয়(Durga puja 2021) বাড়ির সকল সদস্য এক হয়। পুজোর সময় বাড়ির সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-৬০। এছাড়াও স্থানীয় লোকজন, পাড়া পড়শী, এবং বাইরের বহু মানুষ আসেন। সবার সমাগমে বাড়ি আনন্দময় হয়ে ওঠে। পুজোর দায়িত্ব পেয়ে কেমন লাগছে? জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে নিউজ ১৮ লোকালকে (News 18 Local) সায়ন্তনবাবু বলেন, 'বেশ মজা লাগছে। জেঠুর বকা খাচ্ছি। কাজও করছি। নিজের পরিবারের পুজোয় কাজ করা থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে?'
এই বছর লাটাগুড়ি পাল চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো(Durga puja 2021) ৭২তম বর্ষে পদার্পণ করল। ঘটপুজোর মাধ্যমে পুজোর সূচনা হয়। এই প্রথা আজও বহাল। প্রসিদ্ধ তন্ত্রসাধক শ্রী শ্রী শচ্চিদানন্দগিরি মহারাজ প্রথম পুরোহিত হিসেবে পুজো করেছিলেন।
১৯৫০-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই বাড়ির পুজো প্রয়াত নিত্যগোপাল পাল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। ১৯৫৮ সালে নিত্যগোপালের স্ত্রী সুনিতিবালাদেবীর মৃত্যুর পর গুরুদেব বিধান দিয়েছিলেন যে দুর্গাপুজো যেন কোনওমতে বন্ধ না হয়। নিজেদের নামে পুজো বা সংকল্প করতে না পারলে অন্য কারও নামে তা করতে হবে।
সেই রীতি আজও বহাল। ৭২ বছর ধরে দুর্গাপুজো ধারাবাহিকভাবে চলছে।আমাদের একান্ত আপনজনদের এক-এক করে হারিয়েছি। কিন্তু পুজো বন্ধ হয়নি। ধারাবাহিকভাবে তা হয়ে চলেছে। ১৯৬২ সালের পূজার পৌরোহিত্যের দায়িত্ব পালন করেন ময়নাগুড়িনিবাসী প্রতাপ গোস্বামী।
তখন পুজোর সময় চলত নাটক। লাটাগুড়ির জঙ্গল ও বনবস্তি থেকে অনেকেই নাটক দেখতে আসতেন। যেখানে মন্ডপ তৈরী হত, সেখানেই পুজোর পরে নাটমঞ্চ তৈরী করে বিভিন্ন নাটক হত। সেখানে নামীদামি নাট্যকররা আসতেন এবং তাঁদের নাটক মন্ত্রমুগ্ধ করত সবাইকে।
বাড়ির মহিলারা(Durga puja 2021) সমস্ত কাজের দেখভাল করেন এবং দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। দীপা পাল চৌধুরী, অনিমা পাল চৌধুরী, অদিতি পাল চৌধুরী, উমা পাল চৌধুরী, ইলা পাল চৌধুরী, পাপিয়া পাল চৌধুরীরা নিয়ম মেনে পুজো করেন। এছাড়া বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের বউরা রুবি পাল চৌধুরী, সুলক্ষনা পাল চৌধুরী, মৌসুমী পাল চৌধুরী, গার্গী পাল চৌধুরী, রিংকী গুপ্ত, নীলা পাল চৌধুরী, অমৃতা পাল চৌধুরী শিখছেন এবং কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাড়ির মেয়ে জামাইরা অর্পিতা ঘোষ, দেবব্রত ঘোষ, তমালি ও গোপাল ঘোষ, জয়ীতা ও প্রসেনজিৎ দত্ত সমানভাবে দায়িত্ত্ব পালন করেন। নিত্যগোপালবাবুর বড়ো মেয়ে শেফালীকা গুপ্ত, এবং দেবী গাঙ্গুলী আসেন পুজোর সময়। বাড়ির বর্তমান ছেলেরা অনিন্দ্য, অয়ন, সুমন, রাজদীপ, অভিনব, সায়ন্তন, সুপ্রতিক, শৌভিক। এবারে পুজোর দায়িত্ত্ব সায়ন্তন পাল চৌধুরী র। নতুন প্রজন্ম কে পুজোর দায়িত্ব শেখানো হচ্ছে। সাহায্য করছেন বিপ্লব ও স্বপন পাল চৌধুরী(Durga puja 2021)।
বাড়ির প্রথম প্রতিমা এক চালাতেই হত। ছোট পুতুলের মতো প্রতিমা। এক চালাতে প্রতিমা হওয়ার কারণে প্রথম থেকেই ঘাড়ে করে প্রতিমা নিরঞ্জন চালু হয়। যা পাল চৌধুরী বাড়ির ঐতিহ্য হিসাবে বহাল থাকে। বছরের পর বছর প্রতিমা আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে একচালা বা কাঠামোর যুগ শেষ হয়ে গেলেও টিকে রইল (Durga puja 2021)ঘাড়ে করে প্রতিমা নিরঞ্জনের ধারা। এই কারণেই প্রতিমার কাঠামগুলি আলাদা আলাদা হয়ে গেল বহন করার সুবিধার্থে।
তখনকার দিনে পূজার কয়েক’টা দিন মণ্ডপের সামনে টিনের ছাউনি দেওয়া হত। মণ্ডপের ভিতর ও বাইরে সাজসজ্জা হত খবরের কাগজ ও রঙীন কাগজ দিয়ে। রাত জেগে মণ্ডপ(Durga puja 2021) সাজাতো বাড়ির একমাত্র ডেকোরেটর সানু উরিয়া। বাড়ির দুই পরিচারক সানু ও নীলকণ্ঠ সব ব্যাপারেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতো। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব বিষয়ে ওঁদের উৎসাহ ছিল দেখার মতো।
বর্তমাবে মৌলানিনিবাসী মনোজিৎ চক্রবর্তী পৌরোহিত্যের দায়িত্ব পালন করছেন। কোভিডের কারণে এবার প্রতিমার মূর্তি ছোট হয়েছে। অনেকেই হয়ত আসতেও পারছেন না। তবে কোভিডকালেও আয়োজনে একফোটাও ত্রুটি নেই ঐতিহ্যবহনকারী পাল চৌধুরী বাড়ির ৭২তম দুর্গাপুজোয়।
Vaskar Chakraborty