পশ্চিম বর্ধমানের কুলটির মিঠানিতে এই ছবির দেখা মেলে। চক্রবর্তী বাড়ির শতাব্দী প্রাচীন দুর্গাপুজোয় চলে আসছে সেই ৩০০ বছর আগের নিয়মে। বনেদি পরিবারের পুজো শুনলেই একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। বনেদি পরিবারের পুজো চোখের সামনে এঁকে দেয় নানা অলৌকিক ঘটনার ছবি। পারিবারিক বনেদি পুজোগুলি নিয়ে এখনও প্রচলিত রয়েছে অনেক মিথ। এই মিথই পুরোনো পুজোগুলিকে অন্যমাত্রা দেয়। পরিবার মর্ডান হলেও, এখনও ট্রাডিশন মেনে চলে আসছে সেই পুজোগুলি। তারই অন্যতম নিদর্শন মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ির পুজো।
advertisement
আরও পড়ুন: নদী-পাহাড়-জঙ্গল আর দেবীর শক্তিপীঠ! নানা গল্প ছড়িয়ে জয়ন্তীর আনাচেকানাচে, পুজোয় ঘুরে আসুন...
প্রায় ৪০০ বছর আগের ঘটনা। কুলটির মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ি। মূলত নির্ভরশীল ছিল কৃষিকাজের ওপরেই। পরিবারের এক পুরুষ রামলোচন চক্রবর্তী কৃষিকাজের লাঙল দেওয়ার সময় মাটির নীচে থেকে পান অষ্টধাতুর একটি দুর্গামূর্তি। দেবীর স্বপাদেশ পেয়ে তিনি পুজো শুরু করেন মহামায়ার। বেদীর নীচে অষ্টধাতুর মূর্তি রেখে, বেদির ওপরে রাখা হয় মৃন্ময়ী মূর্তি। শুরু হয় পুজো। আজ ৪০০ বছর পরেও একই নিয়মে পুজো করছেন বাড়ির বর্তমান সদস্যরা। চক্রবর্তী বাড়ির পুজোর অন্যতম আকর্ষণ সন্ধিপুজো। এখানে সন্ধিপুজো হয় জলঘড়ি মেনে। যাকে তামিও বলা হয়।
তামি বিষয়টি কী?
পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন, তামি হল একটি তামার পাত্র বা বাটি। যার নীচে থাকে একটি ছোট ছিদ্র। তামার পাত্রটি বসানো থাকে একটি জলভর্তি পাত্রে। তামার পাত্রটি জলভর্তি হয়ে ডুবে গেলে, এক তামি সময় হিসেবে ধরা হয়। পঞ্জিকা মতে, তামির পরে সন্ধিপুজোর বলিদানের উল্লেখ করা থাকে, সেই সময় মেনে হয় বলিদান। তিনি আরও জানিয়েছেন এক তামি সময় হতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট লাগে। সূর্যাস্তের আগে বলিদানের সময় থাকলে, সূর্যোদয়ের সময় থেকে তামি গন্য করা হয়। সূর্যাস্তের পরে বলিদান হলে, সূর্যাস্তের পর থেকেই তামি গন্য করা হয়।
৪০০ বছর আগে যেভাবে পরিবারের গ্রহাচার্য তামির সময় মেনে এই পুজো শুরু করেছিলেন, আজও গ্রহাচার্যের উত্তর পুরুষ সেই নিয়মেই পুজো করেন। পরিবারের সদস্যদের দাবি, জলঘড়ির সময় হয় একদম নির্ভুল। গ্রামবাসীদের কাছেও বিষয়টি আশ্চর্যের। পরিবারের সদস্যরা বলেন, এই তামি দিয়েছিলেন কাশীপুরের মহারাজা। ৪০০ বছর পরেও সেই তামির জলঘড়ি মেনে পুজো হয়। এই জলঘড়ি মিঠানি গ্রামে টেনে নিয়ে আসে বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যদের। জলঘড়ির সময় মেনে বলিদান দেখতে বাইরে থেকেও বহু মানুষ এসে ভিড় করেন।
আরও পড়ুন: পুজোয় একেবারে অন্যরকম বেড়ানোর প্ল্যান চান? ডেস্টিনেশন হোক 'মৌসুনি দ্বীপ'
মিঠানির চক্রবর্তী বাড়ির সন্ধিরপুজোর আরও একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখনও এখানে প্রচলিত রয়েছে সন্ধিডাক। যা সম্পন্ন হয় রিলে সিস্টেমের মাধ্যমে। গ্রহাচার্যের সঙ্গে থাকা ব্রাহ্মণ থেকে শুরু হয়ে সন্ধিডাক পৌঁছে যায় আশপাশের পাঁচটি গ্রামে। এই পদ্ধতিতে ৫০ মিটার দূরে দূরে একজন করে অবস্থান করেন। গ্রহাচার্য সন্ধি বলার পরই, ‘সন্ধি সন্ধি’ বলে রিলে সিস্টেমের মাধ্যমে সেই ডাক পৌঁছে যায় মিঠানির পাশ্ববর্তী পাঁচটি গ্রামে।
চক্রবর্তী বাড়ির প্রতিমার সেই অর্থে কোনও বিশেষত্ব নেই। আক্ষরিক অর্থে সাবেকি দু্র্গা প্রতিমা যেমন হয়, এখানেও সেই একই নিয়ম মেনে চলা হয়। তবে এই পুজোর ক্ষেত্রে গমেশ ও কার্তিকের অবস্থান বিপরীত। একচালা এই প্রতিমাকে সাজানো হয় সোনালী রঙয়ের ডাক সাজে।
পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য নীলরতন চক্রবর্তী বলেছেন, পরিবারের সব ব্যবসা মা দুর্গার নামাঙ্কিত। পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য খনি কাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে দেবীর নামে থাকা অনেক কৃষিজমি বর্তমানে খনিগর্ভে চলে গিয়েছে। তাছাড়াও পরিবারের আর্থিক ক্ষমতা আগের থেকে অনেক কমেছে। তবে পুরোনো সব প্রথা বজায় রেখে এই পুজো করা হয়। বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যরাও, পুজোর কটা দিন বাড়ি ফিরে আসেন। এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীদের উদ্দীপনাও থাকে তুঙ্গে। চক্রবর্তী বাড়ির পাশাপাশি, গ্রামের সব মানুষ মেতে উঠেন মিঠানি গ্রামের চার শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোয়।
Nayan Ghosh