পার্থ খুব ছোট্ট একটা শহর। পশ্চিম-অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের রাজধানী। সিডনি, মেলবোর্ন বা অস্ট্রেলিয়ার অন্য শহরগুলোর একদম উল্টোদিকে। তাই হয়ত পার্থকে বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে আইসোলেটেড, নিরিবিলি, বিচ্ছিন্ন শহর। কিন্তু তাতেও এখানে বাঙালিদের সমাবেশ কম নয়। আর বাঙালি মানে আমাদের সর্বকালের সেরা উৎসব (Durga Puja 2021) হবে না তা কি হয়? সর্বসাকুল্যে চব্বিশ লক্ষ জনসংখ্যার পার্থে বাঙালি মাথাগুলোর আদমশুমারি হয় এই পুজোর সময়।
advertisement
প্রথমে এখানে একটি পুজো কমিটি ছিল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (বা.ও.য়া)। পরে বাঙালিদের সংখ্যা বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পুজোর সংখ্যা। এখন বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও আরও কয়েকটা পুজো হয়। যার মধ্যে অন্যতম- ‘প্রবাসী বাঙালি পুজো কমিটি’, ‘বাংলাদেশি পুজো কমিটি’। এমনকি শুধু মাত্র বাঙালি নয়, উৎসব প্রেমী সব ভারতীয়রাও মাতেন এই উৎসবে, তাদের পুজো কমিটি ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান্স অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া’। সবটাই এই ক’দিনের আনন্দকে আরও একটু চেটেপুটে নেওয়ার ছুতো।
আরও পড়ুন: 'বুর্জ খলিফা'র টানে যেতে হবে না দুবাই! পুজোর শহরেই দেখে নিন পৃথিবীর উচ্চতম নির্মাণ! কোথায় জানেন?
আমাদের এখানে সপ্তাহান্তের পুজোর চল। দিনপঞ্জিকা মতে পুজো (Durga Puja 2021) করা যায় না। শুক্রবার সন্ধ্যেয় ষষ্ঠী, শনিবার সকালে মহাসপ্তমী , শনিবার সন্ধ্যায় মহাষ্টমী, রবিবার সকালে নবমী এবং দশমী। তার অবশ্য একটা কারণ আছে, পুজো সপ্তাহের মাঝে পড়লে ছুটি পাওয়া যায় না, আর যেহেতু এখানে ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ’ সবটাই নিজেদের করতে হয়, তাই সবসময় সম্ভব হয় না দিনক্ষণ মেনে চলা। পুজোর শাড়ি পাঞ্জাবি দেশ থেকে গুছিয়ে আনতে হয় মনে করে। সারা বছর জমিয়ে রাখা শাড়ি পাঞ্জাবি নেমে আসে আলমারি থেকে। পদ্ম পাওয়া যায় না, তাই লোকাল অর্কিড দিয়েই সাধারণত পুজো সারতে হয়।
বাঙালি পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভুরিভোজ, তারও অভাব নেই। তবে এখানে ঠাকুর, জোগানদারের বালাই নেই। আবেগে ভেসে রীতিমত শাড়ি মেকআপ করেও কেউ কেউ হেঁসেলে ঢুকে খুন্তি নাড়েন। পুজোর দু'দিন কমপক্ষে দু’শো তিনশো জনের রান্না হয়। ভোগের খিচুড়ি, লাবরা, টমেটো খেজুরের চাটনি থেকে শুরু করে দশমীর সন্ধ্যেতে ভাত-পাঁঠার মাংসের ঝোল পাত পেড়ে খায় পার্থের বৃহত্তর বাঙালি পরিবার। তবে রান্নার দায়ভার মূলত পুরুষদের।
আরও পড়ুন: কলকাতার আগেই মায়ের বোধন কানাডায়, সাজো সাজো রব টরেন্টো জুড়ে
আমেরিকার মত নামজাদা বাঙালি শিল্পীরা আসেন না প্রোগ্রাম করতে। বরং কয়েকমাস ধরে নিজেদের মধ্যেই রিহার্সাল চলে পুজোর ‘সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’র আয়োজনে। ঠিক যেমন পাড়ার পুজোর প্যান্ডালে হয়, খানিকটা তেমন। সেখানে নামজাদা শিল্পীর চাকচিক্য না থাকতে পারে, কিন্তু থাকে পাড়ার মুখচেনা ছেলে বা মেয়েটার হঠাৎ একদিনের শিল্পী হওয়ার গল্প। এখানে ধুনুচি নাচ হয় কিন্তু আগুন ছাড়া ( ফায়ার আলার্ম বেজে যাবে যে)। সন্ধ্যি পুজোর আরতি ইলেকট্রিক টুনি দিয়ে সারতে হয়, ঢাকি আসেনা, তবে ঢাক আছে। সেখানে তালে তালে নিজেরাই নিজেদের মত বাজানো হয় ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’। সিঁদুর খেলায় চলে নাচ। এখানে ভাসান হয় না মূর্তি। দশমীর পরে প্রতিমা সংরক্ষণ করা হয় পরের বছরের জন্য।
করোনার জন্য অস্ট্রেলিয়ার বর্ডার বন্ধ ২০২০-র মার্চ থেকে। কবে খুলবে সেটাও এখনও নিশ্চিত নয়। অস্ট্রেলিয়া এমনিতেই একটি ব-দ্বীপ। চারপাশে সমুদ্র ঘেরা নিরবিচ্ছিন্ন একটি দেশ, বর্ডার বন্ধ থাকার দরুন এখন আমাদের সত্যি মনে হয়, আমরা বোধ হয় অন্য কোনও পৃথিবীতে বাস করি। গতবছর থেকে পুজোর সময় কলকাতাগামী প্রবাসী বাঙালি যাত্রী বোঝাই উড়োজাহাজগুলো স্তব্ধ। ‘পুজোর সময় বাড়ি যাব’ এই ইচ্ছেগুলো এখন মনে হয় কোনও অলীক স্বপ্ন। তবু পুজোর আবেগকে বাঁচিয়ে রাখতে ধরে নিন কিছু মুষ্টিমেয় বাঙালি একটা বিশাল মাপের ব-দ্বীপে আটকে থেকেও নিজেদের মত আয়োজন করে দেবীর আরাধনার।
আরও পড়ুন: শপিং-পুজোর আয়োজন শেষের পথে, শিউলির সুবাস সঙ্গে নিয়ে 'মা' আসছেন টেক্সাসে
অবশ্য, বর্ডার বন্ধ রাখার দরুন করোনার প্রভাব এখানে খুব একটা নেই।অন্তত ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া প্রায় করোনাশূন্য। তাই এখানে মাস্ক পরে বেরনোটা বাধ্যতামূলক নয়। তবে পুজোর আয়োজনে কিছু রদবদল করতে হয়েছে। আগে যে পুজোগুলোতে বাঙালিদের অবাধ বিচরণ ছিল, সেখানে এখন ৩০০ জনের সীমাবদ্ধতা। বেশ কয়েক মাস আগে থেকে পুজো কমিটিগুলোকে জানিয়ে রাখতে হচ্ছে নিজেদের উপস্থিতি, যাতে সেই মত ওনারাও ৩০০ জনের সীমাবদ্ধতা নিয়ম রক্ষা করতে পারেন।
‘মহামারী কবে শেষ হবে?’, ‘দেশে কবে যেতে পারব?’ এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই। তবে যেটা আছে, সেটা হল বিশ্বাস, ভরসা- ঠিক যেমন মাতৃজঠরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি ভাবে মা তো আছে চিন্তা কিসের? এই বিশ্বাসটুকুই বেঁচে থাক সবার মনে। পারথের এই বৃহত্তর বাঙালি পরিবারের তরফ থেকে সবাই জানাই শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
(লেখিকা ইপ্সিতা মজুমদার ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থের বাসিন্দা)