ঠিক পুজোর (Durga Puja 2021) আগে এই সময় থেকেই, আমাদের আশেপাশে সন্ধ্যে হতেই, এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধে চারিদিক বিভোর হয়ে যেত। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারতাম না, এই গন্ধ কথা থেকে আসছে, কী ফুলেরই বা গন্ধ এটি? পরে জেনেছিলাম, ওই গন্ধটা ছাতিম ফুলের। যে জায়গায় গাছটা থাকে, সেখান থেকে যাবার সময়, খানিকক্ষণের জন্যই সেই মাতাল করা গন্ধকে অনুভব করা যায়। এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন আমার কলকাতা শহরের সঙ্গে ভৌগোলিক অবস্থান লক্ষ যোজন দূর। বহুদিন হয়ে গিয়েছে সেই ছাতিমের গন্ধ আর পাই না!
advertisement
হয়ত বাঙালির পুজোর (Durga Puja 2021) কেনাকাটা এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। ছোটবেলায় বাবা মায়ের হাত ধরে নিউ মার্কেটে যেতাম পুজোর কেনাকাটা করতে। এই দোকান সেই দোকান ঘুরে, হাত ভর্তি নতুন জামা জুতোর ব্যাগ নিয়ে, যখন কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, তখন টুকটাক মুখ চলতো, কখনও ঝালমুড়ি, কখনও বা ফুচকা। চায়ের দোকানগুলোর ভিড়ও ছিল দেখার মতন। আমি হাঁ হয়ে দেখতাম, কী অসম্ভব দক্ষতায় চা-ওলা কাকু কেমন ওপর থেকে একটা মগে করে, চা আর দুধ ঢালাঢালি করছে! কেনাকাটার শেষে একটা সময় আসতো যখন পেটের ভেতর ছুঁচোয় ডন বৈঠক শুরু করে দিয়েছে। বাবার হাত ধরে, ঢুকতাম আমিনিয়া, কিংবা সিরাজে। প্লেট ভর্তি বিরিয়ানী আর চিকেন চাপের গন্ধেই যেন অর্ধেক খিদে মিটতো।
আমেরিকাতে বেশিরভাগ দুর্গাপুজো (Durga Puja 2021) সপ্তাহের শেষ দুদিন অর্থাৎ শনি আর রবিবার করা হয়। এলাকার কোন স্কুলের প্রাঙ্গন বা, স্কুল অডিটোরিয়াম ভাড়া করা হয় দুর্গাপুজো উপলক্ষে। নাহ, এখানে কোনও ডেকরেটর পাওয়া যায় না। তাই মাতৃ আরাধনার অঙ্গন থেকে, শুরু করে সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সবটাই প্রবাসীর ক্লাবের সদস্য সদস্যারা নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে তোলে।
এইতো গত রবিবারই লেক এলিজাবেথ পার্কে প্রবাসীর সদস্যের নিয়ে ছিল পুজোর মিটিং। পুজোর অনুষ্ঠানে কে কী করবে, সেই সব কিছু নিয়েই আলোচনা। ওমা! গিয়ে দেখি সেখানে হাজির ঝালমুড়ি, চা আর বাঙালি সন্দেশ! একেই দুগ্গাপুজোর আলোচনা, তার সঙ্গে চা ঝালমুড়ি! বিকেলটা যেন আরও ঝলমলে হয়ে গেল। মনে হল যেন, এ যেন কলকাতারই কোন পাড়ার পুজোর আলোচনা পর্ব চলছে আমাদের।
প্রত্যেক বছরেই 'বে এরিয়া প্রবাসী' পুজোর অনুষ্ঠানে থাকে, বিশেষ চমক! নাচে, গানে, নাটক ইত্যাদিতে জমে ওঠে পুজোর দুটো দিন। হ্যাঁ আমেরিকাতে বেশিরভাগ পুজোই উইকেন্ডেই হয়ে থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হল, মাত্র দুদিনের পুজো উপলক্ষ্যে, পুজোর সমস্ত সদস্যদের উৎসাহ, উদ্দীপনা শুরু হয়ে যায় প্রায় তিন মাস আগে থেকে। দেশ থেকে, গুণী সংগীত শিল্পীরা যেমন আসেন অনুষ্ঠান করতে, তেমনই প্রবাসীর সদস্যদের ভিন্ন স্বাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, পরিপূর্ন হয়ে ওঠে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব।
২০২০ সালে মহামারীর প্রকোপে সবই প্রায় স্তব্ধ ছিল। কিন্তু মহামারী কাটিয়ে আবার প্রবাসীর বাঙালিরা মেতে উঠতে চলেছে। এই বছর, 'বে এরিয়া প্রবাসী'র পুজোর অনুষ্ঠানে, বিশেষ অতিথি হিসেবে আমাদের মধ্যে পেতে চলেছি, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শ্রীমতি কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে। যার সুরের মূর্ছনায় ভাসবে বে এরিয়ার সংগীতপ্রেমী বাঙালি। এছাড়াও পরিবেশিত হবে প্রবাসীর সদস্য সৌমেন মিত্রের নির্দেশনায় কচিকাঁচাদের একটি নাটক। উমার আগমনের ছন্দে ভেসে, নৃত্যানুষ্ঠান নিবেদিত হবে, বে এরিয়ার নৃত্যশিল্পী, উর্মি চক্রবর্তীর পরিচালনায় গুরু শ্রী সঞ্জীব ভট্টাচাৰ্য'র নেতৃত্বে।
আরও পড়ুন:চলছে ফিনিশিং টাচ, লন্ডনে দুর্গাপুজো মানেই বিলেতের বাঙালির এক উৎসবের মরশুম...
এই লেখা লিখতে লিখতে, বার বারই যেন ফিরে যাচ্ছি ফেলে আসা অতীতে। খুব মনে পড়ে যাচ্ছে, স্কুল জীবনে এই দুর্গাপুজোর প্রায় দু-মাস আগে থেকে, পাড়ার পুজোর অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। দিদিদের নেতৃত্বে, প্রতিদিনই চলতো নাচ বা গানের রিহার্সাল। পাড়ার একঝাঁক ছেলে মেয়ে মিলে হৈ হৈ করে করতাম, কখনও চিত্রাঙ্গদা, কখনও শ্যামা বা চণ্ডালিকা। এই প্রবাসেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। প্রবাসীর সদস্যা তথা অত্যন্ত গুণী সংগীত শিল্পী ডক্টর জয়শ্রী রায়। আমাদের প্রিয় জয়শ্রী দি এক অনন্য সুন্দর ভাবনায় সাজিয়েছে, এবারের পুজোর গানের অনুষ্ঠান। দেবীপক্ষের শুভ সূচনা হবে, তার পরিচালনায়, ও প্রবাসীর অন্যান্য শিল্পী সমন্বয়ে বৈঠকী আড্ডা, যার নাম 'রূপং দেহি'।
প্রবাসীর প্রবীণ সদস্য, শ্রীমতি শমীতা সেন আমাদের প্রিয় শমীতা দি'র সঙ্গে একদিন এই প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, শমীতা দি এক অনন্য সুন্দর কথা আমাকে বললেন, ''আমরা তো সেই কবে আমেরিকাতে এসেছিলাম, যে সময় হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক এতো এতো প্রযুক্তির ব্যবহার কিছুই ছিল না! কিন্তু সেই সময় যাঁরা আমাদের থেকে বয়েসে প্রবীণ, তাঁদেরকে দেখেছিলাম, কী পরম মমতায়, আদরে আমাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছিল। সেই মুহূর্তে কলকাতা থেকে এই দূর দেশে এসে, তাদের ভালোবাসায়, মনে হয়েছিল এ যেন নিজেরই জায়গাতে আমরা আছি।"
"আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ দাদা বৌদির কেমন সুন্দর ভাবে, সদ্য বিদেশে আসা, কিছু তরুণ বাঙালি ছেলে মেয়েদের হাতে, এই পুজোর ভার ভাগ করে দিয়েছিলেন। আজ আমরাও বয়েসের ভারে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু আমাদের হাতে তুলে দেওয়া সেই দাদা দিদিদের, সংকল্পের অঙ্গীকার আমরা তুলে দিয়েছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। আমাদের ছেলে মেয়েরা যাতে এই দেশে থেকেও নিজের শিকড়কে সম্মান জানাতে পারে, সেটাই আমাদের প্রবাসীর একমাত্র লক্ষ্য।"
বে এরিয়া প্রবাসীর বর্তমান সেক্রেটারী, শ্রীমতি বিতান বিশ্বাস। প্রবাসীর পুজো এবং কার্যকলাপ সম্মন্ধে লেখার সময়, কতবার যে বিতান দি'কে ফোন করে জ্বালাতন করেছি আমি। সারাদিনের অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকে, মন দিয়ে আমার কথা শুনেছে, প্রবাসীর কার্যকলাপ নিয়ে এই লেখাতে অনেক তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে।
শমীতা দি, বিতান দি'র কাছ থেকে প্রবাসীর কার্যকলাপ, এবং আগামী প্রজন্ম কে বাংলা সংস্কৃতিকে আরও বেশি করে উন্মীলিত করার যে প্রয়াস সেই কথা শোনার পর মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম, অনেক বড় দায়িত্ব তাঁরা তুলে দিচ্ছেন, আমাদের এই প্রজন্মের হাতে, যে দায়িত্ব আমাদেরকে বারে বারে মনে করিয়ে দেবে, আমাদের শিকড়ের প্রতি, আমাদের দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথা।