পলি আর সমীরণের ছেলের বয়স হল তিন বছর৷ মুখে কথা ফোটেনি৷ ঠাকুরদা ঠাকুমা দাদু দিদা পড়শিরা বলছেন যে শিগ্গির কথার খই ফুটবে৷ মা বাবা ব্যস্ত আইটি প্রফেশনাল৷ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জ্বালায় জীবন অতিষ্ঠ৷ বাড়ির খুদের তাই অনেকটা সময়ের দোসর হল মুঠোফোন৷ সে দিন রাত ভিডিও দেখে চলেছে৷(Autism and speech delay problem)
খুশির বয়স আড়াই৷ দুরন্ত ছটফটে মেয়েটি এখন দাপিয়ে বেড়ায় বাড়িময়৷ অথচ একে নিয়ে এক সময় ঘুম হত না কুহু-কুন্তলের৷ সাত মাস বয়সেই ভূমিষ্ঠ হয় খুশি৷ তার পর যমে-মানুষে টানাটানি৷ তার পর নিকু-র কাচের ঘরে বিপবিপ শব্দের মধ্যে বন্দিদশা কাটে আরও ২১ দিন৷ ডাক্তারবাবু বলেই দিয়েছিলেন যদি এ যাত্রা প্রাণ রক্ষা হয় তাহলেও থাকতে পারে বিপদ৷ হাঁটাচলা, কথা বলা সবেতেই মেয়ে পিছিয়ে যাবে৷ খুশি হাঁটতে শিখল দুই বছর বয়সে৷ তার পর থামা নেই৷ কিন্তু মুখে তার কথা এখনও ফোটেনি৷
‘স্পিচ’ অর্থাৎ কথা বলা, যা আমরা ব্যবহার করি মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের এক মাধ্যম হিসেবে৷ এই ভাষা পরিণতি পায় বিভিন্ন ‘স্টেজ’ অর্থাৎ ধাপের মাধ্যমে৷ যদি কোনও শিশু এই কোনও স্টেজ বা ধাপে পিছিয়ে পড়ে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে ‘স্পিচ ডিলে’ অর্থাৎ ভাষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া বলে উল্লেখ করি৷
আরও পড়ুন : অন্তঃসত্ত্বারা এবং নতুন মা যাঁরা স্তন্যপান করাচ্ছেন, তাঁরা কি টিকা নেবেন? দ্বিধা দূর করলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
এই স্পিচ ডিলে-এর (Speech Delay) সঠিক সময় নির্ণয় করতে না পারলে বাচ্চা উত্তরোত্তর আরও পিছিয়ে পড়তে পারে৷ তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন মা বাবা ও অভিভাবকদের জানা যে কখন তাঁরা সতর্ক হবেন ও বিশেজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন৷
যখন কোনও বাচ্চা ১ বছর বয়সেও সহজন শব্দ যেমন ‘বাবা’, ‘মা’, ‘জল’-এর মতো সহজ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না, ২) দেড় বছর বয়সেও সহজ কিছু নির্দেশ বুঝতে সক্ষম নয়, ৩) ২ বছর বয়সে কোনও অর্থপূর্ণ কথা সংযুক্ত ভাবে বলতে না পারা (যেমন জল খাব, টাটা যাব), ৪) ৩ বছর বয়সে সহজ বাক্যে কথা বলতে না পারা এবং ৫) ৪-৫ বছর বয়সেও সহজ গল্প না বলতে পারা৷
পশ্চিমী তথ্য বলছে যে স্কুলে আগে কথা বলতে পিছিয়ে পড়া শিশুর সংখ্যা ৩ থেকে ১৫ শতাংশ৷ এই সমস্যায় মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা দেড় গুণ বেশি আক্রান্ত৷ তাই হয়তো চলতি ভাষায় একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে ছেলেরা দেরিতে কথা বলে৷ ভাষাগত ভাবে পিছিয়ে থাকা বা ভাষার বিকাশ না হওয়ার বিচিত্র কারণের মধ্যে প্রধান হল বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা অর্থাৎ ইন্টেলেকচুয়াল ডিসএবিলিটি, কানে শোনার অক্ষমতা এবং অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার৷ (Autistic Spectrum Disorder)
আরও পড়ুন : ‘ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজে বছরভর এড়িয়ে চলুন ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার এবং ঠান্ডা জলে স্নান’
এছাড়াও যে বাড়িতে একাধিক ভাষায় কথা বলা হয়, সেই বাড়িতে শিশু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে৷ তবে বিজ্ঞান বলছে, একাধিক ভাষার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা শিশু প্রথমে পিছিয়ে পড়লেও পরে তাদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা থাকে না৷ কিন্তু নিঃসঙ্গ শৈশব যদি মোবাইল বা টিভিতে আসক্ত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ভাষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী৷ কারণ মোবাইল বা টিভিতে একমুখী কমিউনিকেশন হয়৷ এখানে ভাষা বিনিময়ের কোনও সুযোগ আসছে না৷ বাচ্চাটি মোবাইল দেখছে এবং তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে৷ মোবাইলে স্ক্রিনে কার্টুন তীব্র বেগে ছুটছে৷ যে মুহূর্তে সেটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাচ্চা উত্তেজনার খোঁজে হাইপার অ্যাক্টিভ বা অতিসক্রিয় হয়ে পড়ছে৷ এ অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷
তাছাড়া কিছু বাচ্চা জন্মের পর নানা ধরনের অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে যায়৷ একে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে স্টর্মি পেরিনেটাল পিরিয়ড৷ নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া, জন্মের পর না কাঁদা, জন্মের পর রক্তে বা ব্রেনে সংক্রমণ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ সেপসিসের মতো সমস্যার ক্ষেত্রেও ভাষাগত বিকাশে দেরি হওয়া সম্ভব৷ এদের আগে থেকে চিহ্নিত করে ইনটেনসিভ থেরাপি শুরু করা উচিত৷
Dr. Jashodhara Chaudhuri
আরও পড়ুন : ‘সাধারণ সর্দিকাশিতেও বাচ্চার সামনে মাস্ক পরে থাকুন’, মত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞর
ভাষা বলতে আমরা প্রধানত দু’টি জিনিসের সমন্বয় বুঝি-স্পিচ মানে কথা বলা অর্থাৎ আর্টিকুলেশন এবং ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ ভাষা৷ একইসঙ্গে কথা বলা বা ভাষার দু’টি জিনিস-রিসেপটিভ অর্থাৎ বোঝার ক্ষমতা এবং এক্সপ্রেসিভ অর্থাৎ প্রকাশ করার ক্ষমতা৷ যে বাচ্চাটি ভাষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়েছে তাকে দেখে বুঝতে হবে রিসেপ্টিভ না এক্সপ্রেসিভ, কোন ক্ষেত্রে তার সমস্যা আছে৷ অর্থাৎ বাচ্চাটি কথার মানে বুঝতে পারছে কিনা এবং সেটা সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারছে কিনা৷ যদি দেখা যায় বাচ্চাটি বুঝতে পারছে, কিন্তু বলতে পারছে না, তাহলে তার শ্রবণক্ষমতা অক্ষত আছে কিনা দেখতে হবে৷ তাছাড়া বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে তিনি খতিয়ে দেখবেন বাচ্চার অ্যাপ্রাক্সিয়া অব স্পিচ সমস্যা ৷ তার পর সমস্যা বুঝে বিভিন্ন স্পিচ থেরাপি করতে হবে৷
বাচ্চাদের দেরিতে কথা বলার কারণ হিসেবে অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এখন বহুজনবিদিত৷ যদি বাচ্চা এক বছরের মধ্যে নিজের নাম শুনে না তাকায়, নন ভার্বাল কমিউনিকেশন বা কথা ছাড়া মুখভঙ্গি ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারে, নিজের জগতে যদি আবদ্ধ থাকে, মিশতে না পারে, তাহলে সে অটিস্টিক স্পেক্ট্রামের শিকার কিনা জানতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে৷
স্পিচ বা কথা বলানোর জন্য যে গুলি করা উচিত-
১. প্রাথমিকভাবে বাচ্চাকে বুঝতে শেখানো সহজ কথাগুলি-যেমন বল নিয়ে আসার মতো কাজ৷ প্রথমে এক বাক্যের নির্দেশ৷ তার পর ধীরে ধীরে আরও জটিল বাক্যে তাকে বুঝতে শেখানো৷
২. প্যারালাল টক অর্থাৎ আপনি বাচ্চার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছেন বা পারিপার্শ্বিক বর্ণনা করে যাচ্ছেন৷
৩. প্রথমে শেখান নাউন বা বিশেষ্য৷ তার পর ভার্ব বা ক্রিয়াপদ৷ কারণ এই দু’টি ছাড়া বাক্য গঠন সম্ভব নয়৷
৪. ছবির মাধ্যমেও ভাষা শেখানো যেতে পারে
৫. মোবাইল, ট্যাব বা টেলিভিশনের সামনে বাচ্চার দীর্ঘ ক্ষণ বসে থাকার অভ্যাসকে অবিলম্বে বন্ধ করুন৷
স্পিচ ডিলে এখন মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং করোনাকালে সমবয়সিদের সঙ্গে মিশতে না পারার ফলস্বরূপ বা বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিপন্ন শিশুমন যেন আরও ভাষার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে৷ পরিবার ও বিশেষজ্ঞ সবাইকে মিলে সন্ধান পেতে হবে এই ভাষা শেখার চাবিকাঠি, শিশুকে এগিয়ে দিতে হবে নতুন জগতের উদ্দেশে৷
যে সব শিশু পিছিয়ে ছিল ভাষাগত ভাবে, কোভিড পরিস্থিতিতে তারা পড়ছে আরও পিছিয়ে। এখন অতিমারির তরঙ্গ অনেক মৃদু৷ তাই থেরাপিস্টের কাছে শিশুকে নিয়ে যাওয়ার সমস্যার জটিলতা কম৷ তাছাড়া বাড়িতেও আছে সুরাহার পথ৷ কোনও বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অনুযায়ী মা বাবা যদি নিজেরাই থেরাপিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অনেক অনলাইন থেরাপির ভিডিও আছে, যার সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারেন তাঁরা।
সর্বোপরি, বাচ্চাকে সময় দিন। কোনও গ্যাজেটবিহীন সময়। নানা রকম খেলায় মাতুন খুদের সাথে। তার মধ্য দিয়েই ভাষার পাঠ দিন যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় প্লে থেরাপি। কঠিন সময়, কঠিন পরিস্থিতি। তার মধ্যেই এগিয়ে চলা। কোভিডের সঙ্গে যুদ্ধ সম্পূর্ণ শেষ হলে আশা করা যায় এই শিশুদের জন্য পরিস্থতি অনেক সহজ হবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Autism, Speech Delay, Speech Therapy