হোম /খবর /ফিচার /
'বেঙ্গল কেমিক্যাল নামুন... আস্তে লেডিজ'

'বেঙ্গল কেমিক্যাল নামুন... আস্তে লেডিজ'

বেঙ্গল কেমিক্যালস৷PHOTO- FILE

বেঙ্গল কেমিক্যালস৷PHOTO- FILE

গেটে গোদা গোদা বাংলা হরফে লেখা 'বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড'! আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন, সন্তান

  • Last Updated :
  • Share this:

#কলকাতা: 'বেঙ্গল কেমিক্যাল নামুন... আস্তে লেডিজ'...

ফুলবাগান পেরিয়ে বাস থামতেই নামলেন ভদ্রমহিলা, পেরিয়ে গেলেন বড় রাস্তা । উলটো দিকে জ্বলজ্বল করছে একটা বড় লাল লোহার গেট! আজ রং ধূসর, ধুলোর আস্তরণ, তবু একসময়ের গরিমার যৌলুশে দৃপ্ত, শিড়দাঁড়ায় আঘাত থাকলেও  ঋজু ! গেটে গোদা গোদা বাংলা হরফে লেখা 'বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড'! আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন, সন্তান। বলা বাহূল্য, একসময়ে গোটা বিশ্বের গর্ব ছিল এই প্রতিষ্ঠান! আর আজ ?  বিস্মৃতির খাতায়!  কোথায় সেই কদর ? কোথায় সেই আদর ? নিতান্তই একটা বাস স্টপ...!

তখন ১৯০১ সাল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করলেন 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস'। মূলধন বলতে ছিল আটশো টাকা আর ডগমগ করতে থাকা আত্মবিশ্বাস। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে... কালের কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে বেঙ্গল কেমিক্যাল আজ বড় ক্লান্ত, রুগ্ণ, ধুঁকছে! যখন প্রায় সবাই- ই তাকে ভুলতে বসেছে, একটা বাসস্টপ ছাড়া তার অস্তিত্ব আর নেই বললেই চলে, তখন আচমকাই সে খবরে এল।  বর্তমানে গোটা বিশ্বে করোনা হাহাকার। বিপুল চাহিদায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন , যা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় কার্যকরী বলে দাবি চিকিৎসক মহলের। করোনা চিকিৎসার জন্য হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের চাহিদা যখন তুঙ্গে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল একটা ভুয়ো খবর। নায়ক 'বেঙ্গল কেমিক্যালস'!  গতকাল সারাটা দিন ফেসবুক থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরে বেরাল একটাই পোস্ট-- বেঙ্গল কেমিক্যালস-ই পথপ্রদর্শক, এখানেই নাকি তৈরি হয় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কিন্তু এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। বেঙ্গল কেমিক্যালসে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি হয় না। তৈরি হয় কুইনাইনের অন্য দুটি যৌগ - ক্লোরোকুইন ফসফেট ও ক্লোরোকুইন সালফেটের ট্যাবলেট, যা ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে বহু যুগ ধরে এক্সপার্ট মানা হয়।

দেশের প্রথম ওষুধ নির্মাতা সংস্থা, কিন্তু কপালটা খারাপ মানতে হবে! এতদিন বাদে খবরে এল, তাও সেই খবর ভুয়ো! যুগ যুগ ধরে ওষুধ বানানোয় সিদ্ধহস্ত অথচ তাকে ক্রমশ বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে কেন্দ্র! এতে সংস্থার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে! উত্‍পাদনের হার কমেছে, নিয়োগ প্রায় শূন্য, কর্মীদের মধ্যে চালু রয়েছে ১৯৯৭ সালের বেতনক্রম-ই!  কিন্তু তারও একসময়ে সোনালী দিন ছিল।  ১৯২৩ সালে গোটা উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। তাঁদের সাহায্যের জন্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তৈরি করলেন বেঙ্গল রিলিফ কমিটি। সামান্য চাঁদার টাকায় দুর্গত মানুষের মুখে তুলে দেওয়া হল খাবার। এই পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন উপদ্রব শুরু করল কলেরা আর  টাইফয়েড। আক্রান্ত বহু মানুষ। মরণাপন্ন রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতে এগিয়ে এল 'বেঙ্গল কেমিক্যালস'।

আরও খানিকটা ফ্ল্যাশব্যাক... ১৮৯৮ সাল। বেঙ্গল কেমিক্যালসের বয়স তখন মাত্র ৬ বছর। তখন অবশ্য নাম ছিল ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস’। তেমন বড় কারখানা কিছুই নেই, সামান্য ল্যাবরেটরিতে চলে গবেষণার কাজ । এর মধ্যেই কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগ। আক্রান্ত বহু মানুষ। প্লেগের হাত থেকে বাঁচার প্রথম শর্ত ঘর পরিষ্কার এবং পোকামাকড় মুক্ত রাখা। কিন্তু স্যানিটাইজেশনের সমস্ত সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আসে, দামও আকাশছোঁয়া। সেবারও এগিয়ে এল বেঙ্গল কেমিক্যালস। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি করেছিল ফিনাইল আর ন্যাপথলিন বল।

শুধু দেশের সাধারণ মানুষ নয়, সরকারকেও সাহায্য করেছে এই প্রতিষ্ঠান। ১৯১৪ সাল, চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । যুদ্ধের জন্য  ব্রিটিশ সরকারের কিছু অ্যাসিড এবং রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োজন । এতদিন সেসব দ্রব্যের জন্য নির্ভর করা যেত জার্মানির উপর। কিন্তু এখন তো জার্মানি প্রতিপক্ষ দল। তাহলে উপায়? এবারও ত্রাতার ভূমিকায় বেঙ্গল কেমিক্যালস। যুদ্ধের যাবতীয় রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনের দায়িত্ব তুলে নিল নিজের কাঁধে। এখানেই শেষ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও আহত সৈনিকদের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করে বেঙ্গল কেমিক্যালস, অগ্নিযুগের বিপ্লবীরাও নানা সময়ে সাহায্য পেয়েছেন এই সংস্থা থেকে।

১৮৯২ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের উদ্যোগে সাধারণ একটি ভেষজ গবেষণাগার হিসাবে পথচলা শুরু বেঙ্গল কেমিক্যালসের। ধীরে ধীরে ১৯০৫ সালে হয়ে ওঠে রাসায়নিক কারখানা । ক্রমশ বাড়তে থাকে উৎপাদন। ১৯৩১ সালে শুরু হয় গ্ল্যান্ড প্রোডাক্টের প্রস্তুতি, ১৯৩২ সালে ভিটামিন প্রস্তুতি। আজ নাহয় সে খানিক ক্লান্ত, কিন্তু লম্বা রেসের ঘোড়া কী আর দৌড়াতে ভোলে ? আজও তার দম আছে! প্রয়োজন শুধু একটা সুযোগ! এই সময়ে যখন করোনা মোকাবিলায় প্রচুর পরিমাণ ওষুধ প্রয়োজন, তখন দেশের প্রথম ওষুধ নির্মাতা সংস্থাকে জাগিয়ে তুললে ক্ষতি কী ?

Published by:Rukmini Mazumder
First published: