কলকাতা: আয়করে ছাড় পেতে কে না চায়! আয়কর আইনের ৮০সি ধারা তাই বিনিয়োগকারীদের খুব পছন্দের। এই ধারার অধীনে বার্ষিক ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। আসলে আয়কর আইনে এমন অনেক বিধান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ আয়করেও সীমিত ছাড় পেতে পারে। চাকরিজীবীরা তাঁদের প্রথম বেতন থেকেই ধারা ৮০সি-র আওতায় সঞ্চয় বা বিনিয়োগ শুরু করেন। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষ শেষ হতে আর দু'-তিন মাস বাকি। এই সময় কর বাঁচাতে চাইলে ট্যাক্স সেভিংস মিউচুয়াল ফান্ড বা ইএলএসএস-এ বিনিয়োগ করার কথা ভাবা যেতে পারে।
ট্যাক্স সেভিংস মিউচুয়াল ফান্ড বা ইক্যুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিমে (ইএলএসএস) আয়কর আইনের ধারা ৮০সি-র আওতায় ছাড় মেলে। ইএলএসএস-এ সর্বাধিক দেড় লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। এবং প্রতি বছর সেই বিনিয়োগের উপর করছাড় পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এখানে বিনিয়োগের আগে ইএলএসএস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।
ট্যাক্স সেভিংস মিউচুয়াল ফান্ড বা ইএলএসএস স্টকে বিনিয়োগ করে। ফলে এখানে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি বেশি। এই দিকটা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত, বিশেষ করে যদি কেউ ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে প্রথমবার বিনিয়োগ করেন। পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট ইত্যাদি সাধারণ বিনিয়োগ মাধ্যম। ঝুঁকি নেই বললেই চলে। মেয়াদ শেষে মেলে নিশ্চিত রিটার্ন। কিন্তু ইএলএসএস-এ নিশ্চিত রিটার্ন মিলবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। শুধু তাই নয়, বাজার খারাপ থাকলে লোকসানও হতে পারে।
আরও পড়ুন: বাকিদের পিছনে ফেলে FD-তে বিরাট সুদ দিচ্ছে এই ব্যাঙ্ক, জানুন বিশদেএখন প্রশ্ন উঠতে পারে, লোকসানের সম্ভাবনা থাকলে ইএলএসএস-এ বিনিয়োগ করব কেন? প্রথমত, এই স্কিমে দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই স্কিমগুলোতে স্টকে বিনিয়োগ করা হয়। এবং স্টক সাধারণত দীর্ঘ সময়েই উচ্চ রিটার্ন দেয়। যেমন ইএলএসএস-এ ১০ বছর ধরে বিনিয়োগ চালিয়ে গেলে প্রায় ১৫ শতাংশ গড় রিটার্ন পাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। যা সাধারণ বিনিয়োগ মাধ্যমগুলির চেয়ে অনেক বেশি। কিছু ক্ষেত্রে তো দ্বিগুণ।
দ্বিতীয়ত, ট্যাক্স সেভিংস বিনিয়োগ মাধ্যমগুলির মধ্যে ইএলএসএস-এর লক ইন পিরিয়ড সবচেয়ে কম। ধারা ৮০সি-র অধীনে বেশিরভাগ বিনিয়োগ বিকল্পগুলো সরকার সমর্থিত। এগুলোর লক ইন পিরিয়ডও বেশি। উদাহরণ হিসেবে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের কথাই ধরা যাক। এই স্কিমের মেয়াদ ১৫ বছর। ৬ বছর পর আংশিক উইথড্রয়ালের অনুমতি পাওয়া যায়। ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেটের মেয়াদ আবার পাঁচ বছরের। এখন কেউ যদি ৩ বছরের মধ্যে টাকা তুলতে চান তাহলে অবশ্যই ইএলএসএস-এ বিনিয়োগ করা উচিত। তবে তিন বছরে দুর্দান্ত রিটার্ন পাওয়ার আশা না করাই ভাল। সবসময় মাথায় রাখতে হবে, ইক্যুইটি বিনিয়োগ দীর্ঘ সময়ের জন্য। যদি কেউ ন্যূনতম পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে বিনিয়োগ চালিয়ে যেতে পারেন তবেই ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা উচিত।
তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইএলএসএস দিয়েই অনেক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগে হাতেখড়ি হয়। আগেই বলা হয়েছে, এখানে তিন বছরের বাধ্যতামূলক লক ইন পিরিয়ড থাকে। এটা স্টক মার্কেটের অস্থিরতা মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। এরপর যখন ভাল রিটার্ন আসতে শুরু করে তখন পাঁচ বা সাত বছরে আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। যদি কেউ এই স্কিমগুলোতে বিনিয়োগ করতে চান তাহলে নতুন বছরে ভাল রিটার্ন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কয়েকটি ইএলএসএস স্কিমের হদিশ এখানে দেওয়া হল।
২০২৩ সালে বিনিয়োগের জন্য সেরা ইএলএসএস বা ট্যাক্স সেভিংস মিউচুয়াল ফান্ড: এখানে ৭টি ট্যাক্স সেভিংস মিউচুয়াল ফান্ডের তালিকা দেওয়া হল। এই ফান্ডগুলো ধারাবাহিকভাবে ভাল পারফর্ম করছে। এখানে বিনিয়োগ করলে এক দিকে যেমন আয়করে ছাড় পাওয়া যাবে তেমনই অন্য দিকে মিলবে মোটা রিটার্ন। সেগুলো হল - ক) অ্যাক্সিস লং টার্ম ইক্যুইটি ফান্ড, খ) কানাড়া রোবেকো ইক্যুইটি ট্যাক্স সেভার ফান্ড, গ) মিরা অ্যাসেট ট্যাক্স সেভার ফান্ড, ঘ) ইনভেসকো ইন্ডিয়া ট্যাক্স প্ল্যান ফান্ড, ঙ)ডিএসপি ট্যাক্স সেভার ফান্ড, চ) কোয়ান্ট ট্যাক্স প্ল্যান (নতুন সংযোজন), ছ) ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ট্যাক্স অ্যাডভান্টেজ (নতুন সংযোজন)।
কেন এখানে বিনিয়োগ: বিনিয়োগের জন্য কেন এই ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডগুলিকে বেছে নেওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। দেখে নেওয়া যাক সেগুলো।
ক) গড় রোলিং রিটার্ন: গত তিন বছর ধরে প্রতিদিন রোল করা হচ্ছে।
খ) গত তিন বছরে ধারাবাহিকতা: হার্স্ট এক্সপোনেন্ট বা H ফান্ডের ধারাবাহিকতা এবং সামঞ্জস্যতা গণনার জন্য ব্যবহার করা হয়। H সূচক হল একটি ফান্ডের ন্যাভ সিরিজের পরিমাপ। উচ্চ H-এর ফান্ড কম H-এর ফান্ডের তুলনায় কম অস্থিরতা প্রদর্শন করে। ক) যখন H=০.৫, তখন রিটার্নের সিরিজটিকে ‘জ্যামিতিক ব্রাউনিয়ান টাইম সিরিজ’ বলা হয়। এই ধরনের ফান্ড সম্পর্কে পূর্বাভাস করা কঠিন। খ) যখন H, ০.৫-এর কম হয় তখন সিরিজটিকে বলা হয় গড় প্রত্যাবর্তন। গ) যখন H, ০.৫-এর বেশি হয় তখন সেই সিরিজকে স্থায়ী সিরিজ বলা হয়। H-এর মান যত বেশি হবে সিরিজকে তত শক্তিশালী হিসেবে ধরা হবে।
গ) নেতিবাচক ঝুঁকি: এটা পরিমাপের জন্য মিউচুয়াল ফান্ড স্কিম দ্বারা প্রদত্ত নেতিবাচক রিটার্নকে ধরা হয়েছে। X = শূন্যের নিচে ফেরত দেয়, Y = X এর সমস্ত বর্গক্ষেত্রের সমষ্টি, Z = Y/অনুপাত গণনার জন্য নেওয়া দিনের সংখ্যা, ডাউনসাইড রিস্ক = Z এর বর্গমূল।
ঘ) আউটপারফরম্যান্স: গত তিন বছর ধরে আউটপারফরম্যান্সকে ‘জেনসনস আলফা’ দ্বারা পরিমাপ করা হয়। ‘জেনসনস আলফা’ ক্যাপিটাল অ্যাসেট প্রাইসিং মডেল (সিএপিএম) দ্বারা পূর্বাভাস করা প্রত্যাশিত বাজার রিটার্নের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি মিউচুয়াল ফান্ড স্কিম দ্বারা উৎপন্ন ঝুঁকি-সামঞ্জস্যপূর্ণ রিটার্ন দেখায়। উচ্চতর আলফা নির্দেশ করে যে পোর্টফোলিওর কর্মক্ষমতা বাজারের পূর্বাভাসিত আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। এর ফর্মুলা হল – মিউচুয়াল ফান্ড স্কিম দ্বারা উৎপন্ন গড় আয় = [রিস্ক ফ্রি রেট + এমএফ স্কিমের বিটা * {(সূচকের গড় রিটার্ন - ঝুঁকিমুক্ত হার}।
ঙ) সম্পদের আকার: ইক্যুইটি ফান্ডের জন্য থ্রেশহোল্ড অ্যাসেটের আকার হল ৫০ কোটি টাকা।
ইএলএসএস-এর সঙ্গে অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনা: লক ইন পিরিয়ড - ইএলএসএস-এ মাত্র ৩ বছরের লক ইন পিরিয়ড থাকে। যা সমস্ত ট্যাক্স সেভিংস বিনিয়োগ বিকল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। যার মধ্যে রয়েছে এফডি ফিক্সড ডিপোজিট, পিপিএফ (পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড), এনপিএস (ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম), এনএসসি (জাতীয় সঞ্চয় শংসাপত্র) ইত্যাদি।
উচ্চ আয় বা লাভ বা সুবিধা - ইএলএসএস-এ অন্যান্য ট্যাক্স সেভিংস বিনিয়োগমাধ্যমগুলির তুলনায় বেশি রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি ইএলএসএস থেকে ১৫-১৮ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যেতে পারে।
আয়কর ছাড়: ইএলএসএস-এ আয়কর আইনের ধারা ৮০সি-র অধীনে বার্ষিক ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করছাড় তো পাওয়া যায়ই। এছাড়া অন্যান্য কর সুবিধাও মেলে। ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে ইএলএসএস থেকে এক বছরে প্রাপ্ত ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত রিটার্ন বা লাভের উপরেও কোনও কর নেওয়া হয় না। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, ইএলএসএস তার বিনিয়োগকারীদের জন্য দু’ভাবে আয় তৈরি করে – লভ্যাংশ এবং মূলধন লাভ (রিডিম মূল্য এবং ক্রয় মূল্যের মধ্যে পার্থক্য)। লভ্যাংশ এবং মূলধন লাভের জন্য কর আলাদা। মূলধন লাভকে আবার স্বল্পমেয়াদি মূলধন লাভ (১ বছরের কম হোল্ডিং পিরিয়ড) এবং দীর্ঘমেয়াদি মূলধন লাভে (১ বছর এবং তার বেশি হোল্ডিং পিরিয়ড) ভাগ করা যায়। একটি ইএলএসএস-এ কোনও স্বল্পমেয়াদি মূলধন লাভ নেই কারণ এটি ৩ বছরের লক ইন পিরিয়ড সহ আসে। ইএলএসএস-এ অর্জিত দীর্ঘমেয়াদি মূলধন লাভের উপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়, কিন্তু যখন তা ১ লক্ষ টাকার বেশি হয়।
এসআইপি: ইএলএসএস একমাত্র ট্যাক্স সেভিংস বিকল্প যা এসআইপি-র সুবিধা প্রদান করে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। সর্বোচ্চ বিনিয়োগের কোনও সীমা নেই।
সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ বিনিয়োগ: ইএলএসএস-এ সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ বিনিয়োগ স্কিমের উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণত, কমপক্ষে ৫০০০ টাকা লাম্পসাম এবং কমপক্ষে ৫০০ টাকা এসআইপিতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। কোনও নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ সীমা নেই।
ইএলএসএস-এ কি ইনডেক্সশনের সুবিধা পাওয়া যায়: না। ইএলএসএস থেকে পাওয়া রিটার্ন বা লাভের উপর ইনডেক্সশনের সুবিধা পাওয়া যায় না।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: ELSS, Investment, Tax Savings Mutual Fund