সালটা ছিল ১৭ই মার্চ ১৯৮৩, মাত্র আঠারো বছর বয়সে চন্দননগর খলিসানি কলেজে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি প্রথমবার রক্ত দিতে গিয়ে সুচ দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। তবে সে বারই প্রথম তারপর আর তিনি জীবনে ভয় পাননি বরং হাসিমুখে রক্তদান করেন। যেখানেই রক্তদান শিবির হয় সেখানেই তিনি ছুটে যান। বছরে চারবার রক্তদান করেন প্রশান্ত।
advertisement
আরও পড়ুন: পুকুরে স্নান করতে গিয়ে বিপত্তি, জলে ডুবে মৃত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয়েছিল তার বন্ধু অলক কুমার মন্ডলের সঙ্গে। তার বাড়ি চন্দননগরের নাড়ুযায়। পিছিয়ে নেই তার বন্ধুও। ৫৭ বছর বয়সে ৭৭ বার রক্ত দিয়ে “হাফ সেঞ্চুরি” করে ফেলেছেন অলকবাবু। বর্তমানে দুজনেই চন্দননগর খলিসানি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি লিঃ কর্মরত। প্রশান্ত বাবু ম্যানেজার পদে রয়েছেন আর অলক বাবু ক্যাশিয়ার পদে।
আরও পড়ুন: মাথায় চুল নেই, নেই পায়ের শক্তি! এই নারীর অসামান্য জীবন, কাহিনী জানলে অবাক হবেন
প্রথম প্রথম প্রশান্তবাবুর পরিবার তাকে রক্ত দিত বারণ করতো। কিন্তু তাদের কথা তিনি শোনেননি। পরে তার মা তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। অবিবাহিত জীবনে দিদি, দাদা, বৌদি ও ভাইপোকে নিয়ে চলে তার সংসার। কাজের মতই রক্তদান তার জীবনের নেশা। ১৯৮৩ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যতবার রক্ত দিয়েছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য রেখে দিয়েছেন তিনি। তার ঝুলিতে রয়েছে সোনা ও রুপোর মেডেল। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ১০০ বার রক্তদানের জন্য রয়েছে একাধিক পুরস্কার ও স্বারক। ২০০২ এর ১৯শে ডিসেম্বর সেবামূলক কাজের জন্য তৎকালীন রাজ্যপাল বীরেন জে শাহর কাছ থেকে “সেবা মেডেল” পুরস্কার পান তিনি। রাজ্যের তরফে সেন্ট জন্স অ্যাম্বুলেন্স ব্রিগেড পুরস্কার পান। ২০০৫ সালে দিল্লির একটি সংস্থা গোল্ড ফেরি ফিলিপিস “সাহসিকতার অ্যাওয়ার্ড, গোল্ড মেডেল, সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকার চেক প্রদান করেন প্রশান্ত বাবুকে । সেই পুরস্কার কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী।
২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল বিছানস কাউন্সিল এর তরফে ইন্দিরা গান্ধী এক্সিলেটর অ্যাওয়ার্ড পান। ২০২৪ সালে উড়িষ্যা সম্বলপুরে দেশরত্ন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়েছেন। বিরসা মুন্ডা অ্যাওয়ার্ড ও ১০০ বার রক্ত দেওয়ার জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্য ভবন থেকেও দেওয়া হয় পুরস্কার। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তার উদ্যোগে ৫০টি ব্লাড ডোনেশন ক্যাম করা হয়েছে, সেখানে মোট ৩৯ হাজার ৩০ জন রক্ত দিয়েছিলেন তার নথিও রয়েছে তার কাছে। বর্তমানে একাধিক ব্লাড ডোনেশন সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন প্রশান্ত ও অলক বাবু।
প্রশান্ত বাবু বলেন, এখনো পর্যন্ত ১৩৬ বার রক্ত দিয়েছি যেটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। কারণ আমার রক্তে একটা মানুষের জীবন বাঁচবে। ১৮ বছর বয়স থেকে রক্ত দিচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে রক্তদান শিবির হয় সেখানে গিয়ে তিন মাস অন্তর রক্ত দিয়ে আসি। বছরে চারবার রক্ত দিয়ে। যতক্ষণ শরীর চলবে ততক্ষণ রক্ত দেবো, তবে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত রক্ত দেওয়া যায়। দিল্লি ,আলিপুরদুয়ার, উড়িষ্যা সহ বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরস্কার পেয়েছি। আগামী দিনে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার অর্থাৎ পদ্মশ্রী পুরস্কারে পেলে তাহলে আমার জীবন ধন্য হবে। মূলত নতুন প্রজন্মকে আমার এটাই দেখানো যে ১০০ বারের অধিক রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া যায়।
প্রশান্তর বন্ধু অলোক মন্ডল জানান, একই সাথে কলেজে পড়াশোনা করেছি, এনএসএস-এ ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রশান্তর সাথে পরিচয় হয়েছিল। এখনো পর্যন্ত আমি ৭৭ বার রক্ত দিয়েছি। এখনো পর্যন্ত সেবা মেডেল সহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছে। তবে আমার পরিবার কখনো রক্তদানে বাধা দেয়নি কারণ আমার স্ত্রী সহ পরিবারের সকলেই রক্ত দান করে। আমরা চিরস্থায়ী নই তাই নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের একটাই বার্তা সকলে যেন রক্তদানে এগিয়ে আসে ।
এ প্রসঙ্গে হুগলি জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারী মৃদঙ্গ মৌলি কর জানান, রক্ত দেওয়ার জন্য বেশ কিছু নিয়ম আছে। তিন মাসের আগে দ্বিতীয়বার রক্ত দেওয়া যায় না। একজন মানুষ বছরে তিন থেকে চারবার রক্ত দেওয়া উচিত নয়। তবে তিনি ১৮ থেকে ৫৭ বছর বয়সের মধ্যে এতবার দেওয়ার কথা না। তবে উনি এতবার রক্ত দিয়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য । তবে বারবার রক্ত দিলে শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। তবে উনি যে উদ্দেশ্যে দিচ্ছেন উনি যদি অসুস্থ হয়ে যান তবে তার কথা শুনে বাকিরাও পিছিয়ে যাবে। সবাইকে বলব অতি উৎসাহিত হয়ে এই কাজটা না করাটাই ভালো।
রাহী হালদার