ডলি রানা মহিলা বাস কন্ডাক্টর। মহিলা হিসাবে এই কঠিন পেশাকে বেছে নেওয়ার মূল কারণ হল, বাবার স্বপ্ন পূরণ। বাবার ইচ্ছে ছিল সামর্থ্য হলে বাস কিনবেন। বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে নিজের গয়না বেঁচে এবং লোন নিয়ে বাস কিনেছেন। তারপরই জীবনের আরও কঠিন লড়াই শুরু ডলির। ঘর সংসার ছেড়ে, একজন মহিলা চলন্ত বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এভাবে কন্ডাক্টরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই পেশায় তাঁকে দেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল জাগে মানুষের। অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন।
advertisement
প্রতিদিন ভোররাতে ঘুম ভেঙে দুপুরের খাবার নিয়ে বাসে ওঠা। তারপর দিন শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরা। কঠিন জীবন যুদ্ধ রোজ লড়ছেন হাওড়ার ডলি। বাবার স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে পরিবারের রুজিরুটির যোগান দিতেই কয়েক বছর আগে একটি পুরনো বাস কেনেন। সেই বাস বাঁচিয়ে রাখতে নিজেই কন্ডাক্টর হয়েছেন।
ডলি জানান, ২০১৭ সালে বাস কেনার পরকয়েক বছর পার হয়। তারপর করোনা অতিমারীর ভয়াবহ সেই পরিস্থিতি। তার জেরে হঠাৎ লকডাউন, দিনের পর দিন বাসের চাকা বন্ধ। স্টপেজে আটকে বাস। এর কয়েক মাস পর বাস চলা শুরু করে। কিন্তু সেই সময় রাস্তায় প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা খুবই কম। এক এক করে বিভিন্ন রুটে বন্ধ হয়। অনেক বাস মালিকই ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ান। তবে স্বপ্নের এই বাসকে নিয়েই দাঁতে-দাঁত চেপ নতুন ভাবে লড়াই শুরু করেন ৫৮ বছরের ডলি।
জানান, একসময় ড্রাইভার, কন্ডাক্টর রেখে বাস চালাতেন। এমন বহুদিন হয়েছে রাতে টাকা নিতে এসে শূন্য হাতেই ফিরেছেন। চোখের জল মুছে দিনের পর দিন ধৈর্য ধরে মনকে শান্ত রেখেছেন, সুদিনের আশায়। চরম অর্থনৈতিক সমস্যাতেও দিনের পর দিন কেটেছে। তারপরই মনস্থির করেন এই বাস টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকে হাল ধরতে হবে। বাসের ইএমআই, ডাইভার কন্ডাক্টরের খরচ প্রতিদিন উঠছে না দেখে বাধ্য হয়ে একদিন, নিজেই বাসের টিকিটের ব্যাগ হাতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েন। জেদ আর কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সমস্যা ফিকে হতে থাকে। শোধ হয় বাসের লোন। বর্তমানে বাস চালিয়ে ড্রাইভার বাস মেরামতির তেল খরচ বাদেও, প্রতিদিনই সামান্য কিছু টাকা হাতে থাকে, তাতেই দিন চলছে।
ডলি জানান, বাস কেনার কয়েক মাস পরই বাবা মারা যান। আর কয়েক বছর বেঁচে থাকলে হয়তো এই সুদিন দেখতে পেতেন, আরও বেশি খুশি হতেন। বর্তমানে পরিবার বলতে, নিজের কোনও সন্তান নেই। স্বামী-স্ত্রী, বোন ভাইদের নিয়ে সংসার। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে খুশি। প্রতিদিন ভোরে উঠে বোন খাবার তৈরি করে দেন। খাবার নিয়ে কোনা ৫৭ বাস স্টপেজে হাজির হন। কোনা-হাওড়া স্টেশন, কোনা-ধর্মতলা। প্রতিদিন ৪-৫ ট্রিপ সেরে রাত ৯.৩০ বা ১০ নাগাদ বাড়ি ফরে স্নান ভাত খেয়ে বিছানায় যান, তারপর আবার ভোরে উঠে দিন শুরু। সপ্তাহে রবিবার একটা দিন ছুটি, বিশ্রাম পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। এখন তার এই কঠিন লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়ে সহযোগিতা করছে নিজের বনপো।
রাকেশ মাইতি