পূর্ব রেলের শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন স্টেশন গোবরডাঙা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন এই জনপদে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আমলে গড়ে উঠেছিল রেলস্টেশনটি। বর্তমান গোবরডাঙা স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাঁদিকে চোখ রাখলে, নজরে না-পড়া একটি ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম আজও দেখা যায়। ছোট্ট ওই প্ল্যাটফর্ম আজও গোবরডাঙার জমিদারদের সম্মান রক্ষার্থের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে। যা লোকমুখে প্রচলিত ‘সাড়ে তিন নম্বর’ প্ল্যাটফর্ম বলেই।
advertisement
মালগাড়িতে হাতি উঠবে, তাই এই প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে একসময় গোবরডাঙার জমিদারের মুখরক্ষা করেছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। জানা যায়, গোবরডাঙার জমিদারদের বেজায় প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। বাংলাদেশ লাগোয়া এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসকরা রেললাইন পেতেছিল বহু আগেই। শিয়ালদহ থেকে সেই রেললাইন সোজা চলে গিয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা পর্যন্ত।
আরও পড়ুনঃ ১৪০ বছরের জন্মদিন! বাংলার এই স্টেশনে রাত ১২টায় যা ঘটল, অবাক গোটা দেশ
গোবরডাঙার জমিদারের লেঠেলবাহিনীর সুনাম গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরেছিল। এ ছাড়া নীল বিদ্রোহের নায়ক তিতুমিরের সঙ্গে এই জমিদারদের সংঘাতের কথাও জানা যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। সেই সময়ে গোবরডাঙার জমিদারদের হাতির কথাও ছড়িয়ে পরেছিল গোটা বঙ্গদেশে। গোবরডাঙার জমিদাররা হাতিতে চড়ে শিকার করতেও বেরতেন। তাঁদের হাতিশালায় রাখা থাকত দেশ-বিদেশের বিস্তর হাতি।
গোবরডাঙায় পুরনো জমিদারবাড়ির পাশে আজও পিলখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গোবরডাঙার জমিদারদের হাতির শখের কথা সেসময় ঢাকার নবাবের কানেও পৌঁছয়। তিনি বেশ কয়েকটি ভাল মানের হাতি চেয়ে পাঠান।
আরও পড়ুনঃ রবিবার প্রাথমিকের টেট, পরীক্ষার্থীদের কী কী নিয়ম মানতে হবে, এক ক্লিকে জানুন
ঢাকার নবাবের এই নির্দেশের পরই গোবরডাঙার জমিদারমশাই পরলেন মহা সমস্যায়। এত অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এত দূরের পথ পাঠানো সম্ভব হবে হাতিদের! জমিদারমশাই তখন স্মরণাপন্ন হলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের। ব্রিটিশ শাসনের সেই সময়, দমদম থেকে বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশের খুলনা পর্যন্ত নিয়মিত রেল চলাচল করত। তাই ঠিক হয়, মালগাড়িতেই হাতি পাঠানো হবে নবাবের কাছে।
কিন্তু বিশালকায় হাতিগুলিকে কীভাবে ট্রেনে তোলা যাবে? নবাবের ফরমান, যত দ্রুত সম্ভব হাতি পাঠাতে হবে। শেষপর্যন্ত জমিদারের মান বাঁচাতে এগিয়ে আসে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। জমিদারের আবদারে রেলগাড়িতে হাতি তোলার জন্য বানিয়ে দেওয়া হয় একটি অতিরিক্ত প্ল্যাটফর্ম। রেলগাড়িতে উঠবে হাতি, তাই গোবরডাঙার জমিদারের মান বাঁচাতে তৈরি হল এই ‘এলিফ্যান্ট প্ল্যাটফর্ম’। পরবর্তীকালে জমিদারবাড়ির সদস্য ও লোকলস্কর ট্রেনে নামা-ওঠার জন্য এই প্ল্যাটফর্মটিই ব্যবহার করতেন। পরবর্তী সময়ে কালের নিয়মে এটি লোক মুখে 'সাড়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম ' নামেই পরিচিত হয়ে যায়।
গোবরডাঙা রেলস্টেশনের বয়স আজ প্রায় ১৪০ বছর। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে গেলে গুরুত্ব হারান জমিদাররা। পরবর্তীতে অনেক বছর পর্যন্ত এই এলিফ্যান্ট প্ল্যাটফর্মে পণ্যবাহী মালগাড়ি থেকে মালপত্র নামানো হত। প্ল্যাটফর্মের গায়ে তৈরি করা হয় রেলের একটি গুদামঘরও। পরে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ভেঙে ফেলে রেল কর্তৃপক্ষ। আর দীর্ঘদিনের অযত্ন ও অব্যবহৃত থাকার ফলে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঢাকা পরে যায় সাড়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম এর ইতিহাস। তবে বর্তমানে এই সাড়ে তিন নম্বর প্লাটফর্মটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব মাথায় রেখে, প্ল্যাটফর্মটি সংস্কার ও রেলের ঐতিহ্য-স্মারকে স্থান দেওয়ার দাবি তুলছেন গোবরডাঙার শিক্ষিত সমাজ।
রুদ্র নারায়ন রায়