নয়াদিল্লি: যে কোনও ভোটের আগে ভোটদাতাদের বিনামূল্যে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নতুন কিছু নয়। তা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে বর্তমানে এই দান-খয়রাতি সংক্রান্ত বিষয়টাই (Freebies Culture) ভারতের অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর হয়ে উঠছে বলে ইতিমধ্যেই নিদান দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)। আসলে ভোট পাওয়ার জন্য ভোটের আগে জনগণকে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা বিনামূল্য পাইয়ে দেওয়ার মতো নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন রাজনৈতিক নেতারা। আর সেই প্রস্তাবে প্রভাবিত হয় জনসাধারণও।
advertisement
এ-বার ভোটে জেতার পর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গেলে খরচ বাড়ে। যার ফলে চরম বিপাকে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তবে আম আদমি পার্টি (Aam Aadmi Party) বা আপ (AAP) এই খয়রাতির নীতি নির্লজ্জ ভাবে গ্রহণ করার পর থেকেই তা নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে চরম বিতর্কের ঝড় উঠেছে। আসলে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় ভোটারদের থেকে ভোট পাওয়ার উদ্দেশ্যে খয়রাতির নীতি অনুসরণ করে ঘুষ দিয়েছিল আপ (AAP)। যার পক্ষপাতমূলক প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে। বর্তমানে এই বিষয়টি আদালতের সামনে পেশ করা হয়েছে। তবে আদালতের বিচারের মাধ্যমে এর সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। মজার বিষয় হল, সরকারও এই বিষয়টা সামলানোর ক্ষেত্রে বেশ উদাসীন। উল্টে তারা নির্বাচন কমিশন (Election Commission)-এর কাঁধে এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের দায় চাপিয়ে দিয়েছে। এই খয়রাতিগুলি শুধুমাত্র ঘুষ কিংবা তাদের অর্থনৈতিক এবং বাজেটের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নয়, এর পাশাপাশি ভারতীয় রাজনীতির কার্যকারিতার ক্ষেত্রেও বড়সড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন- সত্যি এত বড়? শরীর থেকে বেরিয়ে আসে কাঁটা, পাখি ধরে তাদের খেয়ে ফেলে এই প্রজাতির মাকড়সা?
আসলে আন্তর্জাতিক, ঐতিহাসিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক - এই সমস্ত দিক থেকেই দান-খয়রাতি (Freebies) অত্যন্ত জটিল বিষয়। আর অবশ্যই এর মধ্যে যথেষ্ট বুদ্ধিও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বলা যাক। একটি বিধ্বংসী আগুনে শহর পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাওয়ার পর রোমের জনগণকে বিনামূল্যে শস্য দান করেছিলেন প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকের কুখ্যাত সম্রাট নিরো (Nero)। তবে এই খয়রাতি করার জন্য অবশ্য রোমান সাম্রাজ্যের বাকি অংশকে ধ্বংসাত্মক ভাবে লুট করেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, সেই লুঠপাটের বেশ ভাল অংশ নিজের জন্যও রেখে দিয়েছিলেন নিরো। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, খয়রাতির আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এর থেকে লাভবান হন খয়রাতি দানকারীও। তা-হলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই খয়রাতির অর্থ মেটায় কে বা কারা?
জনসাধারণের ভর্তুকি (Subsidy) বা প্রকৃতপক্ষে অন্যদের- যে কোনও উদ্দেশ্যেই হোক না কেন দান-খয়রাতি আসলে জনসাধারণের বৃহত্তর টাইপোলজির একটি প্রকাশ মাত্র। দিল্লিতে পরিবহণ এবং ছাড়-সহ বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের খয়রাতির জন্য ভারতের এমএসপি এবং সার ভর্তুকির একটি অংশ খরচ হয়ে থাকে। অর্থাৎ এটা পুরোপুরি বিনামূল্যে নয়, বরং এর জন্য সামান্য অংশ প্রদান করতে হয়। তবে উভয় ধরনের খয়রাতির ক্ষেত্রে সমস্যা কিন্তু একই রকম হয়।
সাধারণ ভাবে, দেশের বহু রাজ্যের জন্যই এই খয়রাতি মেটানোর খরচ এবং জনকল্যাণ মূলক অনুষ্ঠানের খরচ বেশ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এই কারণে এই মুহূর্তে পঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যের প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ঘনাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আরও অনেক রাজ্যে বাজেট সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে সবথেকে বিপজ্জনক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পঞ্জাবের বিদ্যুৎ ভর্তুকি। আর রাজ্যের তহবিলে এর ক্রমবর্ধমান খরচ মোট রাজস্বের ১৬ শতাংশেরও বেশি। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন বরাদ্দ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করছে এই রাজস্ব ব্য়য়। শিল্পক্ষেত্রের উপর যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পঞ্জাবে এটা একটা বড় সমস্যা তৈরি করছে। যদিও সেখানে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মাসুল তামিলনাড়ুর মতোই। অর্থাৎ যা গুজরাতের থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। আবার গৃহকাজে ব্যবহারকারীদের জন্য ভর্তুকির নীতিতে পঞ্জাব এবং তামিলনাড়ু উভয় রাজ্যেরই কাঁধেই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঋণের বোঝা চেপেছে।
বাজেটের বরাদ্দের উপর বড়সড় প্রভাব ফেলে খয়রাতি এবং ভর্তুকি। আর সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হল, ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য মূলধন বিনিয়োগের সাম্প্রতিক খরচের মাধ্যমে ফলস্বরূপ ত্যাগ। যা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ভারতের ক্ষমতাকে মজবুত করে। যদি বর্তমান মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চিনের পর্যায়ে যেতে প্রত্যাশিত ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেঞ্চমার্কে পৌঁছতে হয়, তা-হলে এটা ভারতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। নির্বিচারে খয়রাতি এবং সামাজিক কল্যাণমূলক ভর্তুকির কারণে যখন কিছু রাজ্য প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়, তখন রাজনৈতিক তাৎপর্য সংক্রান্ত দ্বিতীয় সমস্যাটি হল ক্রস সাবসিডি, যা এড়ানো যায় না।
খয়রাতি এবং সামাজিক কল্যাণমূলক স্কিমগুলি আসলে জনগণকে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। আর এটা সব ক্ষেত্রেই সর্বজনীন একটি সমস্যা। সেটা ক্রমবর্ধমান মূল্যের ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসই-এর আকারেই হোক না-কেন। অথবা বিনামূল্যে ডেলিভারি অথবা সমস্ত উন্নত দেশে বেকার অথবা প্রতিবন্ধীদের জন্য কল্যাণমূলক সুবিধা দেওয়াও হতে পারে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই খরচ মেটানোটা একটা বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে পরিমিত বাজেটের অর্থ ব্যবহারের বিকল্প বেছে নেওয়াটাও বেশ কঠিন।
খয়রাতি সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। যা ভারত এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলির জন্য বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্য়ূনতম স্বচ্ছলদের জন্য ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনামূল্যে প্রদান করা নৈতিক ভাবে একেবারেই নিন্দনীয় নয়। তবে এটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকার অর্থ হচ্ছে, ফুলে-ফেঁপে যাওয়া ভর্তুকির বিলের মাধ্যমে বর্তমানের জন্য ভবিষ্যৎকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া। এই খয়রাতির ফলাফল কিন্তু যথেষ্ট গুরুতর। এমনকী তা কিছু রাজ্যের দেউলিয়া হওয়ার জন্য দায়ী থাকবে। যদিও এ-নিয়ে ততটাও মাথা ঘামান না রাজনীতিবিদেরা।
আরও পড়ুন- প্রেসিডেন্সি জেলের অন্দরে এবার সিসি ক্যামেরার নজরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দরিদ্রদের কাছে বর্তমান সহনশীলতার ভবিষ্যৎ সুবিধার বিষয়ে যুক্তি তৈরি করা খুবই মুশকিল। আসলে রোজকার রোজকার বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। ফলে খাবার এবং আশ্রয়টুকুর জন্যও ব্য়য় করতে অক্ষম তাঁরা। আর তাঁদের বৈদ্যুতিক কিংবা শক্তি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাকেও ছাপিয়ে যায় এই দুটি বিষয়ের গুরুত্ব।
আর শেষ পর্যন্ত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ কায়েম করার জন্য নির্দয় রাজনীতিবিদেরা এই বিষয়গুলির সুযোগ নেবেন। ঠিক যেটা করে দেখিয়েছে আম আদমি পার্টি। তারা দেখিয়ে দিয়েছে যে, এটা ভোটে জেতার জন্য কত বড় অস্ত্র হতে পারে। তবে সবথেকে বড় বিপদ লুকিয়ে রয়েছে খয়রাতিতে। যেটা যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক নেতারা। আসলে এই হাতিয়ারটা ব্যবহার করে বিদেশি প্রতিপক্ষের হাতে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিতে সাহায্য করছে তারা। এর পাশাপাশি তারা জাতীয় স্বার্থকেও গুরুতর ভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আর এই ধরনের বিপদের মধ্যে অন্যতম হল ২০০৮ সালে ভারতীয় কংগ্রেস এবং চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে স্বাক্ষরিত মউ (MoU)। যার কারণে ভারতীয় নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এই সব খয়রাতির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ভাবে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। কারণ প্রতিটা ক্ষেত্রেই দরিদ্রদের অ্যাকাউন্টে অগণিত বৈধ প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়। ধারের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করার জন্য রাজ্যগুলিকে অনুমোদন দেওয়াটাও বেশ সমস্যার। যদিও দ্ব্যর্থহীন নীতি নির্দেশিকা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান।
যদি খয়রাতি এবং ভর্তুকির বিতরণে কোনও যৌক্তিকতা চালু করতে হয়, তা-হলে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের সবার আগে ভোটদাতাদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক অন্যায় এবং দুর্নীতির কারণে বিশাল বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যা পূরণ করতে হবে দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরই। আসলে এর জন্যই দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয় জনসাধারণ। ফলে তখন রাজনৈতিক নেতাদের দেওয়া তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করার তুলনায় হাতের সামনে যে সুযোগ রয়েছে, সেটাই গ্রহণ করে তারা। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) গুজরাতে যে পন্থা দেখিয়েছেন, সেই ভাবে জনসাধারণের মনোভাব সহজেই পাল্টানো যেতে পারে। ওই রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের বিনিময়ে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করাতে রাজ্যের নাগরিকদের রাজি করিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। অথচ এই ভোটাররাই সম্প্রতি গুজরাত ভোটের সময় আপ-এর খয়রাতির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
এ-ভাবেই এক দিন হয় তো ভারত স্ক্যান্ডেনেভিয়ান সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট (Scandinavian social contract)-এ পৌঁছতে পারবে। যা মানুষকে আরও ভাল কিছুর বিনিময়ে স্ব-আরোপিত সংযমের অভ্যেস গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করবে। যদিও এর জন্য অবশ্যই ভারতকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি (GDP) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।