জানা গিয়েছে, এর মধ্যে ১৮৬০ সালে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (ভারতীয় দণ্ডবিধি)-র পরিবর্তে আনা হয়েছে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ (ফৌজদারি দণ্ডবিধি) নবরূপে এসেছে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ হিসাবে এবং ১৮৭২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ (ভারতীয় সাক্ষ্য আইন)-এর বদলে ১ জুলাই থেকে কার্যকর হচ্ছে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।
advertisement
এর মধ্যে নতুন আইনে কোন অপরাধে কী কী সাজার কথা বলা হয়েছে, তা বিস্তারিত রূপে এখনও জানা যায়নি৷ তবে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় জুড়েছে ২০টি নয়া বিধি৷ বাদ পড়েছে ১৯টি পুরনো বিধান৷ ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় ১৭৭টি বিধি সংশোধন তরা হয়েছে৷ ৩৫টি বিধান বাদ পড়েছে সুরক্ষা সংহিতায়৷ সাক্ষ্য অধিনিয়মে সংশোধন করা হয়েছে ২৪টি বিধান এবং বাদ দেওয়া হয়েছে ৬টি৷
উল্লেখযোগ্য ভাবে, নতুন এই আইনে জোর দেওয়া হয়েছে নারী সুরক্ষা ও অধিকারের উপরে৷ অভিযুক্তদের অধিকারকেও মজবুত করা হয়েছে৷ যোগ হয়েছে গণপিটুনির মতো অপরাধের জন্য পৃথক ধারা৷ বদল করা হয়েছে ‘দেশদ্রোহিতা’র সংজ্ঞা৷
আরও পড়ুন: ভোট মিটতেই বাড়ল পেট্রল-ডিজেলের দাম! মাসের শুরুতেই ধাক্কা, একলাফে কতটা বৃদ্ধি?
বিধানগুলির মধ্যে রয়েছে, যে কোনও থানায় জিরো এফআইআর দায়ের করার ক্ষমতা, পুলিশ অভিযোগের অনলাইন নিবন্ধন, ইলেকট্রনিক সমন প্রদান এবং সমস্ত জঘন্য অপরাধের জন্য অপরাধ দৃশ্যের বাধ্যতামূলক ভিডিওগ্রাফি। এই ব্যবস্থাগুলির লক্ষ্য ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মধ্যে দক্ষতা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা।
নতুন আইনের অধীনে, ভুক্তভোগীরা এফআইআর-এর একটি বিনামূল্যের অনুলিপি পাবেন এবং গ্রেফতারির পরে কোনও নির্বাচিত ব্যক্তিকে তাঁদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানোর অধিকার পাবেন। এটি আইনি কার্যক্রমে অবিলম্বে সহায়তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য করা হয়েছে।
নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এই নতুন বিধিতে৷ তথ্য রেকর্ড করার দু’মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে তদন্ত। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য নির্যাতিতরা ৯০ দিনের মধ্যে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট পাবেন।
নতুন আইনে নারী সুরক্ষা এবং নারীদের সঙ্গে ঘটা বিভিন্ন অপরাধের ক্ষেত্রে বিধি আরও কঠোর করা হয়েছে। নয়া আইনে ১৮ বছরের কমবয়সি অর্থাৎ নাবালিকা ধর্ষণে সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা আজীবন কারাদণ্ড। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২০ বছর থেকে আজীবন কারাবাসের সাজার কথা বলা হয়েছে। যৌন হিংসার মামলার ক্ষেত্রে নির্যাতিতার বয়ান নেওয়া হবে তাঁরই বাড়িতে। এক জন মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সেই বয়ান নথিবদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়। বিয়ে বা অন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহিলাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অপরাধের জন্য ১০ বছরের সাজার কথা বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: লোকাল ট্রেনে দুর্ঘটনা হাবড়ায়! অল্পের জন্য রক্ষা… বন্ধ থাকে শিয়ালদহগামী ট্রেন, দুর্ভোগে যাত্রীরা
এত দিন দেশে গণপিটুনির ক্ষেত্রে কোনও আলাদা আইন ছিল না। এ বার এমন অপরাধে কারও মৃত্যু হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি, পরিবেশ দূষণ এবং মানব পাচারের মতো অপরাধকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় সাজার আওতায় আনা হয়েছে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় দেশদ্রোহের মতো অপরাধকে সরিয়ে তার পরিবর্তে ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করাকে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। নতুন আইনে সেই অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট সাজার কথাও বলা রয়েছে।
বৃহত্তর স্বার্থে কোনও ব্যক্তিকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে। পুলিশকে কোনও অপরাধের তদন্তের স্বার্থে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার কথাও রয়েছে নতুন আইনে। বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে মামলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিষয়ও উল্লেখ রয়েছে।
মোদি সরকারের এই তিন আইন নিয়ে শুরু থেকেই ছিল বিতর্ক। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি বিরোধী দলগুলি। শুধু সংসদের ভিতরে নয়, বাইরেও তা নিয়ে সমান প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বেও তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে ছিল ন্যায় সংহিতা সংক্রান্ত প্রতিবাদ। এমনকি, এই আইন বাতিলের দাবিও তুলেছিলেন বিরোধীরা। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও করা হয়। কিন্তু, লাভ হয়নি।
এত বিতর্কের মধ্যেও সংসদের দুই কক্ষেই পাশ হয়ে যায় তিন অপরাধমূলক আইনের বিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সেই বিলে সই করেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মূ। আর চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয় ১ জুলাই থেকে দেশে এই তিন নতুন আইন কার্যকর হবে।
বিরোধীদের আপত্তি মূলত দেশদ্রোহিতা সংক্রান্ত বিধি নিয়ে। প্রসঙ্গত, আইপিসি-র ১২৪(ক) ধারাটিতে ‘দেশদ্রোহিতা’ নামক অপরাধটি এ বারের ন্যায় সংহিতায় ১৫২ ধারাতে রয়েছে। তবে ওই শব্দটি বাদ দিয়ে প্রায় একই ভাষায় দেশের ‘সার্বভৌমতা ও ঐক্য’র যে কোনও বিরোধিতার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের কথা রয়েছে।
বিরোধীরা মনে করছে, এর বলে সরকার সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা করলেই দমনমূলক পদক্ষেপ করতে পারবে। অপরাধ এবং সন্ত্রাস দমনে যে নতুন ধারাগুলি যুক্ত হয়েছে, সেগুলিতেও সরাসরি অধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। কংগ্রেস-সহ অন্য বিরোধী দলগুলিও তাড়াহুড়ো করে বিল পাশের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিল পাশ করাতে বেগ পেতে হয়নি মোদিদের। এ বার সেই নতুন আইনই বলবৎ হল দেশে।