একইসঙ্গে এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মণিপালের হাসপাতাল থেকে সুস্থ হওয়া রোগীরাও, জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কীভাবে তাঁরা পাশে পেয়েছেন মণিপালের ডাক্তারদের জানালেন নিজের মুখেই। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা শাকি রেজওয়ানা রজনী জানান, একসময় তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠার সব আশা প্রায় হারিয়েই গেছিল, সেইসময় বিশেষ চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্গালুরুতে যাওয়ার কথা ভেবেও তাঁরা কলকাতার মণিপাল হাসপাতালকে বেছে নেন এবং বর্তমানে তিনি সুস্থ। শুধু তাই নয়, নিউজ১৮ বাংলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি এও জানান যে, শরীরের নানাবিধ সমস্যা থাকার কারণে একসময় তাঁকে বলা হয়েছিল মা হওয়ার কথা যেন তিনি তখনই না ভাবেন, তবে মণিপালে চিকিৎসার পর মাত্র ২ বছরের মধ্যেই তিনি মা হওয়ার স্বপ্নও পূরণ করতে পেরেছেন, এবং গোটা বিষয়টার জন্য তিনি অবশ্যই কুর্নিশ জানিয়েছেন মণিপাল হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে।
advertisement
তবে শুধু তিনিই নন হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশংসা করছেন অন্যান্য রোগীরাও। এই প্রসঙ্গে আরও একজন রোগী ছবি নাগ জানান তাঁর বর্তমান বয়স ৭৩, তিনি ভাবতেও পারেন নি যে এই বয়সে এসে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তিনি, তবে তা সম্ভব হয়েছে এবং যেই কারণে নিজের ডাক্তারের প্রতি তিনি চিরকৃতজ্ঞ! তবে এক্ষেত্রে তিনি জানিয়েছেন তাঁর এই লড়াইয়ের অংশীদার তাঁর মেয়েও, কারণ মেয়ে পাশে না থাকলে তিনি একা জীবন যুদ্ধের এই লড়াইয়ে সফল হতে পারতেন না। এদিন মণিপাল হাসপাতাল এই সকল মহিলার লড়াইকে কুর্নিশ জানায়।
“দ্য পাওয়ার অফ হার” শুধুমাত্র একটি থিম নয়; এটি এক দৃঢ় ঘোষণা যে যখন একজন নারী ক্ষমতায়িত হন, তখন পুরো সমাজ তার সুফল ভোগ করে। নারীরা সমাজের নীরব স্থপতি, যারা কর্মজীবন, পরিবার এবং সামাজিক প্রত্যাশার ভারসাম্য রক্ষা করেন, অথচ তাদের নিজেদের সুস্থতা অনেক সময়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। “পাওয়ার অফ হার” হলো সেই সুস্থতার অধিকার পুনরুদ্ধার করা, যাতে প্রতিটি নারী তার স্বাস্থ্য, স্বপ্ন ও কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে পারেন।
অনুষ্ঠানটির সূচনা হয় জরুরি জীবন রক্ষাকারী বেসিক লাইফ সাপোর্ট (BLS) ও কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (CPR) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, যা অংশগ্রহণকারীদের জরুরি সঙ্কটে সঠিক প্রতিক্রিয়া জানানোর দক্ষতা প্রদান করে। এরপর এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যার মধ্যে ছিল ঐতিহ্যবাহী প্রদীপ প্রজ্জ্বলন।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ ছিল চিকিৎসকদের দ্বারা পরিচালিত ডক্টর ও পেশেন্ট কেস স্টাডি সেশন। এখানে ডাক্তার সুতানু হাজরা (সিনিয়র কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান – অর্থোপেডিক্স, মুকুন্দপুর ইউনিট), ডাঃ পারিজাত দেব চৌধুরী (কনসালটেন্ট – ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি, মুকুন্দপুর ইউনিট), ডাঃ সঞ্চিলা তালুকদার (কনসালটেন্ট – প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, মুকুন্দপুর ইউনিট), ডাঃ পূজা আগরওয়াল (কনসালটেন্ট – সার্জিক্যাল অনকোলজি, মেডিকা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল), ডাঃ অরিন্দম পাণ্ডে (সিনিয়র কনসালটেন্ট – কার্ডিওলজি, মেডিকা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল), ডাঃ অমিতাভ ঘোষ (কনসালটেন্ট – জেনারেল ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি, ঢাকুরিয়া ইউনিট), ডাঃ শাশ্বতী সিনহা (কনসালটেন্ট – ক্রিটিক্যাল কেয়ার, ঢাকুরিয়া ইউনিট), ডাঃ ইরিনা দে (কনসালটেন্ট – প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ), এবং ডাঃ অংসু সেন (কনসালটেন্ট – নিউরোলজি, সল্টলেক ইউনিট) বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক চিকিৎসা কেস শেয়ার করেন, যা নারীদের অসামান্য সাহস ও সময়োপযোগী চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন বদলের কাহিনী তুলে ধরে।
আরও পড়ুনঃ অন্যের কথাই সহজে ভেঙে পড়েন? ছোট্ট ছোট্ট উপায়ে মুক্তি মিলবে, সহজ উপায় দিলেন বিশেষজ্ঞ
এরপর এক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নারীদের বিভিন্ন জীবনপর্যায়ের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত শোনা যায়। প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ প্রেরণা গোয়েঙ্কা (কনসালটেন্ট – শিশু ও নবজাতক স্বাস্থ্য, সল্টলেক ইউনিট), ডাঃ অভিনিবেশ চ্যাটার্জী (কনসালটেন্ট – প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, সল্টলেক ইউনিট), ডাঃ সঞ্চিলা তালুকদার (কনসালটেন্ট – প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, মুকুন্দপুর ইউনিট), ডাঃ অরুণাভ রায় (সিনিয়র কনসালটেন্ট ও প্রধান – গাইনোকলজিক অনকোলজি ও ওমেন ক্যান্সার ইনিশিয়েটিভ, মেডিকা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল), ডাঃ রাজীব বসু (কনসালটেন্ট – অর্থোপেডিক্স, ঢাকুরিয়া ইউনিট) এবং ডাঃ শুভাশিস রায় চৌধুরী (সিনিয়র কনসালটেন্ট – ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি, ব্রডওয়ে ইউনিট)।
আলোচনায়, ডাঃ প্রেরণা গোয়েঙ্কা বলেন, ‘কিশোরী মেয়েদের পুষ্টির অভাব, বিশেষত ক্যালসিয়াম ও আয়রনের ঘাটতি তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।’ ডাঃ অভিনিবেশ চ্যাটার্জী বলেন, ‘কৈশোরকালীন পরিবর্তন, স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন এবং যৌন শিক্ষার বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যক, যা ভবিষ্যতের জন্য সঠিক স্বাস্থ্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।’
ডাঃ অরুণাভ রায় বলেন, ‘স্তন ক্যান্সার এবং জরায়ু ক্যান্সারের মাত্রা বাড়ছে, তাই প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা গ্রহণের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।’ ডাঃ রাজীব বসু বলেন, ‘মধ্যবয়সী মহিলাদের মধ্যে অস্টিওপরোসিস ও বাতের সমস্যা বেশি দেখা যায়, যা সময় মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এড়ানো সম্ভব।’ ডাঃ শুভাশিস রায় চৌধুরী বলেন, ‘নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে, অথচ এর লক্ষণগুলি অনেকসময় উপেক্ষিত থেকে যায়। নিয়মিত হার্ট চেক-আপ, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ স্বাস্থ্য আলোচনার পাশাপাশি, অনুষ্ঠানে নারী উদ্যোক্তাদের সম্মান জানানো হয়, যারা প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। ডাঃ সঞ্চিলা তালুকদার বলেন, ‘PCOD, অনিয়মিত মাসিক, রক্তাল্পতা, স্থূলতা এবং মেনোপজ সংক্রান্ত সমস্যাগুলি মহিলাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।’ নিউজ ১৮ বাংলাকে তিনি জানান মহিলাদের মেনোপজ বা PCOD সংক্রান্ত এই ধরণের রোগগুলি নিয়ন্ত্রণের মূল উপায়ই হল স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা। মহিলাদের ধূমপানের বিষয়ে সতর্কতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
নিউজ ১৮ বাংলাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডাঃ জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় চৌধুরি জানান, বর্তমানে মধ্যবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে হাড়ের সমস্যা, শরীরে বিভিন্ন অংশ্যে ব্যথা বেদনার লক্ষণ দেখা যায়। তিনি জানান এটা মূলত বেড়েছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ শুরু হওয়ার পর, কারণ এক্ষেত্রে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক ভঙ্গিতে বসে কাজ করেন না বাড়িতে। এছাড়াও যাঁরা মূলত টেবিল চেয়ারে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন তাঁদের উচিত কিছুক্ষণ অন্তর একটু ‘ব্রেক’ নিয়ে হাঁটা, নাহলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা গুরুতর সম্ভাবনা থেকেই যায়। সকলকেই নিজের ‘লাইফস্টাইল’ এবং খাদ্যাভাসের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।