উত্তর ২৪ পরগনা বনগাঁর বাগদা থানা এলাকার বইখোলা গ্রামের বাসিন্দা ৫৬ বছর বয়সি সূর্যকান্ত মণ্ডল ছিলেন ভাগচাষি৷ গত শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর ভ্যানে করে বাঁশ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময়ই পাঁচিলে তাঁর মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেদিন রাতেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ওইদিন থেকেই এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ভর্তির পর থেকেই কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি ৷ রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে আরও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা জানান, ব্রেন ডেথ হয়ে গিয়েছে।
advertisement
সল্টলেক স্বাস্থ্য ভবনের ব্রেন ডেথ কমিটি অ্যাপনিয়া টেস্ট করে জানিয়ে দেয়, ব্রেন ডেথ হয়ে গিয়েছে সংগ্রামের। নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যা পৌনে আটটা নাগাদ চূড়ান্তভাবে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করে ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর পরই চূড়ান্ত শোকের আবহেই পরিবারের সদস্যরা অঙ্গদান করতে চান। দ্রুত অঙ্গদানে সম্মতি জানায় সূর্যকান্তর পরিবার।
আরও পড়ুন : 'নিজের বোনের' ভোট প্রচারে জমজমাট ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুর লড়াই!
এরপরই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয় অঙ্গ গ্রহীতাদের সঙ্গে ম্যাচিং। হাওড়া শিবপুরের বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সি দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের হার্টের সঙ্গে ম্যাচিং সম্পূর্ণ হয়। বুধবার বিকেলে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে গ্রিন করিডোরে সূর্যকান্ত বাবুর হৃদযন্ত্র নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া আন্দুলের নারায়ণা হাসপাতালে। সেখানেই এই হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করে দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যকে নতুন জীবন দান করলেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন : তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত সচ্চিদানন্দ, তনিমা! নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর শাস্তি
অন্যদিকে লিভার, দুটি কিডনি এসএসকেএম হাসপাতালেই অন্য তিনজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়া শংকর নেত্রালয় হাসপাতালে কর্নিয়া দান করা হয়েছে এবং ত্বক এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : কয়লাকাণ্ডে বিকাশ মিশ্রর বিরুদ্ধে এবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল আদালত
এসএসকেএম হাসপাতালে নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসক তথা অঙ্গদান আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অর্পিতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘সূর্যকান্ত মণ্ডলের পরিবার যেভাবে এগিয়ে এল তা উদাহরণযোগ্য। আমাদের রাজ্যে অঙ্গদান এখনও অনেক পিছিয়ে তবে গত বেশ কয়েক বছর ধরে সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ যদি আরও বেশি সচেতন হয়, তবে আমরা আরও অনেক মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারব।’’
অন্যদিকে নারায়ণা হাসপাতালের পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা আর ভেঙ্কটেশ জানান, ‘‘আমরা সূর্যকান্ত মণ্ডলের পরিবারের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এ ছাড়া সমস্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে তা কুর্নিশযোগ্য। অঙ্গদান শুধু প্রয়োজনীয় নয়, মৃতপ্রায় মানুষকে নতুন জীবনদানের ক্ষেত্রে এর বিকল্প কিছু হতে পারে না।আগামী দিনে আমাদের প্রত্যেকের উচিত অঙ্গ দানে আরও বেশি করে এগিয়ে আসার এবং অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার।’’ করনা আবহে গোটা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া জন্য যে চিকিৎসক-নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা জড়িত ছিলেন, তাদের প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষা করা হয়। ৫১ জনের করোনা পরীক্ষা করার পর প্রত্যেকের রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরই তারা এই গোটা ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়াও প্রত্যেক গ্রহীতার করনা পরীক্ষাও করা হয়।
অতিমারি পর্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল এই মরণোত্তর অঙ্গদান। গ্রামের গরিব কৃষক সূর্যকান্ত মণ্ডলের দুই কন্যা। একজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, অন্যজন কলেজপড়ুয়া। সমস্ত শোক নিয়েও অন্যদের জীবন বাঁচাতে গোটা পরিবারের নজিরবিহীন পদক্ষেপ একটা কথাই আবার প্রমাণ করল, মানুষ মানুষের জন্য।