প্রথমে জেনে নেওয়া যাক শীতকালীন অলিম্পিক্স আসলে কী...
গ্রীসের রাজা জিউসের পুত্র হারকিউলিসের হাত ধরেই মূলত অলিম্পিক্সের সূচনা। শুরুর দিকে অলিম্পিক্সে যুক্ত ছিল সাড়া পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশ। মূলত প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পিক গেমস। একেবারে প্রথম থেকে না হলেও কালের নিয়মে দিনের ক্রমশ অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণকারী দেশের পাশাপাশি ক্রীড়াবিদদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই বর্তমানে কয়েক দশক আগে থেকেই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নানা রকমের খেলা বা প্রতিযোগিতার সংখ্যা। ফলে প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিক্স গেমস অনুষ্ঠিত হলেও প্রয়োজনের সাপেক্ষে নানা রকমের প্রতিযোগিতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অলিম্পিক্সকে ভাগ করা হয়েছে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিকের দুটি আসরে। যেমন গ্রীষ্মকালে ফুটবল, সাঁতার, দৌড় প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ভরা শীতকালে বরফের মধ্যেও রয়েছে অলিম্পিক্সের একাধিক প্রতিযোগিতা। যেমন আইস স্কেটিং, আইস হকির মতো খেলাও। ফলে প্রতি চার বছর অন্তর যে কোনও শীতপ্রধান দেশে জমজমাট আসর বসে শীতকালীন অলিম্পিক্সের একাধিক প্রতিযোগিতা। ২০১৮ সালে শীতকালীন অলিম্পিক্সের আসর বসেছিল রাশিয়ায়। এবার অর্থাৎ ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক্সের আসর বসেছে চিনে। কিন্তু সাম্প্রতিক করোনা নিয়ে গোটা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে বেজিং।
advertisement
আরও পড়ুন - গরু পাচার কাণ্ডে সিবিআই-এর মুখোমুখি দেব, নিজাম প্যালেসে হাজিরা তারকা সাংসদের
অলিম্পিক আয়োজক দেশকে কীভাবে নির্বাচন করা হয়?
জানা গিয়েছে, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে রয়েছেন বিশ্বের ১০০টি দেশের প্রতিনিধিরা। মূলত তাঁদের ভোটদানের মাধ্যমেই নির্বাচিত করা হয় আয়োজক দেশকে। কিন্তু সাম্প্রতিক করোনা আবহে এই প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে বর্তমানে এই প্রক্রিয়াটি কর্তৃত্বের ভার রয়েছে অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট বা সভাপতির ওপর। তবে বিগত কয়েক বছর আগে ভোট প্রক্রিয়ায় কারচুপির কারণে তা পর পর দু'বার ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিও এবং ২০২০ সালে জাপানের অলিম্পিক নির্বাচনকে কলুষিত করেছিল। এগুলি ছিল মূলত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর। তবে এবার পালা শীতকালীন অলিম্পিকের। সেই আসরে ইতিমধ্যেই আয়োজক দেশ হিসাবে নিজেদের নাম কয়েক বছর আগে পাকাপোক্ত করেছে বেজিং।
আরও পড়ুন - পাঁচ-ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে গেলেন সাংসদ দেব, বললেন, এনামুলকে চিনি না
২০২২ শীতকালীন অলিম্পিকের জন্য বেজিংকে বেছে নেওয়া হল কেন?
জানা গিয়েছে, চিনের রাজধানী বেজিং-এ এবার অর্থাৎ ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আসরে ইতিমধ্যেই অংশগ্রহণ করেছেন গোটা বিশ্বের প্রায় ৯১টি দেশের ২৮৭১ জন প্রতিযোগী। অলিম্পিক উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সাজো সাজো রব গোটা বেজিংয়ে। ২০১৮ সালে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ার বরফাবৃত সোচিতে। ওই প্রতিযোগিতার আসরে নরওয়ে, সুইডেনের একাধিক প্রতিযোগী মাদক সেবন করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায় ইতিমধ্যেই ওই দুই দেশকে বড় অঙ্কের জরিমানা ধার্য করেছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। ফলে ইতিমধ্যেই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে আগেই ওই দুই দেশ ছিটকে গিয়েছে অলিম্পিকের আসর বসানোর ভোটদানের প্রক্রিয়া থেকে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক করোনা আবহে এমনিতেই বেহাল আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন ইউরোপের একাধিক দেশ। এই অবস্থায় আর্থিক খরা কাটিয়ে এই সব দেশের পক্ষে অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতার আসর বসানো একপ্রকার অসম্ভব। ফলে বেহাল অর্থনীতির কারণে অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতার আসর বসানোর প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ইউরোপের একাধিক দেশ। এমনকী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের জন্য জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড ইতিমধ্যেই তাদের দেশের জনগণের পালের হাওয়া বুঝে ওই ভোটদানের প্রক্রিয়া থেকে আগেই নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি জার্মানির থমাস ব্যাচ তাঁর দেশের মানুষের এ হেন আচরণে হতাশ বলেই জানিয়েছেন। পাশাপাশি পোল্যান্ড ও সুইডেনের, এমনকী ইউক্রেনের মতো বরফাবৃত শীতপ্রধান দেশও আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে অলিম্পিকের আসর বসানোর তালিকা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় বেশ কয়েক যোজন দূরে। ফলে এতেই সোনায় সোহাগা বেজিংয়ের।
তবে শুধুমাত্র একটি কারণ নয়, ২০২২ শীতকালীন অলিম্পিকের জন্য চিনকে মনোনীত করার একাধিক কারণ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত করার প্রক্রিয়াটি মূলত সম্পন্ন হয়েছে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বর্তমান ১০০ জন সদস্যের ভোট দানের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালে ভোট দানের প্রক্রিয়া চলাকালীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ নরওয়ের রাজার একটি অনৈতিক আচরণে ক্ষুব্ধ হন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। ফলে একে তো বেহাল অর্থনীতি, তার ওপর পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণে ওই ভোটাভুটির প্রক্রিয়ায় বিশ্বের একাধিক দেশকে পেছনের সারিতে ফেলে দিয়ে ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আসর বসানোর তালিকায় নিজেদের নাম শক্ত করে নেয় বেজিং। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সদস্যরা চিন ও কাজাকিস্তানের মধ্যে বেজিংকেই বেছে নেন ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতার আসর বসানোর তালিকায়।
কেন বেজিং এই দায়িত্ব পেল, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে গোটা বিশ্ব বিশ্ব জুড়ে। কারণ হিসাবে গোটা বিশ্বের একাধিক দেশ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দিকে। এবার দেখে নেওয়া যাক কী সেই বিতর্ক।
১. একাধিক দেশের প্রশ্ন যেখানে গোটা বিশ্বে বায়ু দূষণের ঘাঁটি হিসাবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে বেজিংকে, সেখানে অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতা কীভাবে বেজিংয়ের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও চিনের ভৌগোলিক পরিধি ও আবহাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক দেশ। তাদের দাবি চিনের যে স্থানে অলিম্পিকের আসর বসানো হয়েছে সেখানে রাস্তাঘাট বেশ সঙ্কীর্ণ। এছাড়াও সেখানকার আবহাওয়ায় বায়ু দূষণের মাত্রা অতিরিক্ত। দূষণের মাত্রা অতিরিক্ত হওয়ায় বেজিংয়ের মতো জায়গায় অলিপিকের মতো আসর বসানো ঠিক হয়নি বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
আবহাওয়ার অগ্রগতি সত্ত্বেও গত বছর বেইজিংয়ের বার্ষিক গড় বায়ু দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা দ্বারা নির্ধারিত সীমার ছয় গুণেরও বেশি ছিল। ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কির সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের লরি মাইলিভার্তা বলেছেন, বেজিং শহরটিকে ঘিরে থাকা কয়লা-পোড়ানো শিল্পের থেকে নির্গত ধোঁয়ার জন্যই খারাপ বাতাসের সৃষ্টি হচ্ছে এবং দূষণ বাড়ছে। দূষণের মাত্রা দিনের বেলা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। দিনের বেলা বিশেষ করে গাড়ি চলাচলের জন্য যে ধোঁয়া নির্গমন হয় এবং শিল্প কলকারখানা থেকে কয়লার নির্গত ধোঁয়া এবং কার্বন ডাই অক্সাইড অত্যধিক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করছে। প্রশাসনিক স্তরে নিয়মিত আলোচনা করে কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে বিষয়ে নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। সমগ্র দেশের যান চলাচল এবং কল-কারখানাগুলির উপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
২. এছাড়াও ক্রীড়া বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, যেখানে ইতিমধ্যেই করোনা নিয়ে গোটা বিশ্ববাসীর প্রশ্নের মুখে চিন, সেখানে ওই দেশে অলিম্পিকের আসরে যুক্ত ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ও নির্বাচক মণ্ডলীর খাবারের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের দাবি ইতিমধ্যেই বিশ্বের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে চিনের হাঁস-মুরগির মাংস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেখানে বর্তমান করোনা আবহে অলিম্পিক উপলক্ষ্যে চিনে যাওয়া বিশ্বের একাধিক দেশের মানুষদের নিরাপদ থাকা একপ্রকার অসম্ভব বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে ক্রীড়াবিশেষজ্ঞরা পাশাপাশি একাধিক যতই প্রশ্ন তুলুন না কেন, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বর্তমান সভাপতি থমাস ব্যাচ বলেছেন, অলিম্পিক উপলক্ষ্যে মূলত যে বিষয়গুলির ওপর বেশি নজর দেওয়া হয়, সেগুলি হল,
১. আয়োজক দেশের আর্থিক পরিকাঠামো।
২. উপযুক্ত ভৌগলিক অবস্থান যেমন রাস্তাঘাট, হোটেল ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, তা বেজিংয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাচ।
৩. এ বিষয়ে ব্যাচ বলেছেন, এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করার জন্য আয়োজক দেশ প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। আয়োজনের জন্য খরচ করা অর্থ আয়োজক দেশকে তুলতে সাহায্য করাই অলিম্পিক কমিটির লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই লক্ষ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি কাজ করছে। এ বিষয়ে ব্যাচ উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক করোনা আবহে বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবীর পাশাপাশি ইউরোপের অর্থনীতি। ইউরোপের একাধিক দেশ অলিম্পিক গেমসের প্রতিযোগিতার আসর বসাতে অসমর্থ হওয়ায় তাঁর আর কিছু করার ছিল না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও ২০২০ সালে করোনা দাপটের মাত্রা অতিরিক্ত হওয়ায় এবং তা মহামারী রূপ নেওয়ায় জাপান ওই বছর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর বসানোর তালিকায় মনোনীত হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতা বাতিল করে জাপান সরকার। এর জন্য তিনি জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিক খরা কাটিয়ে ইউরোপের দেশগুলি যে ফের অলিম্পিকের মতো বড় প্রতিযোগিতার আসর তাদের দেশে বসাতে সমর্থ হবে সে বিষয়ে আশা প্রকাশ করে ব্যাচ বলেছেন, ২০২৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিস এবং ২০২৬ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত হবে অলিম্পিকের পরবর্তী আসর।