তার পর সব ঠিকঠাকই ছিল। ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের (Delta Variant) দাপট কমে যায় এক সময়। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছিল মানুষ। উৎসবের মরসুমে মানুষ মেতেও উঠেছিল। যদিও করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের প্রসঙ্গে একটা কানাঘুষো চলছিলই। কিন্তু সেই আশঙ্কাই বোধহয় এ বার সত্যি হতে চলেছে। এর পিছনে দায়ী দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়ান্ট ওমিক্রন (Omicron)। যা ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। কারণ এই নতুন স্ট্রেনটি মারাত্মক রকম সংক্রামক। আর এর জেরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণও। সেই সঙ্গে বাড়ছে কোভিড সংক্রমণের হারও। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কপালে ভাঁজ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ মহলের। তাদের আশঙ্কা, সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের দামামা বেজে গিয়েছে।
advertisement
আরও পড়ুন : জরুরিকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য ছাড়পত্র অ্যান্টিভাইরাল পিল এবং দু’টি ভ্যাকসিনে
করোনা পরিস্থিতি ট্র্যাক করার জন্য ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে একটি করোনাভাইরাস ট্র্যাকার (Coronavirus Tracker) তৈরি করা হয়েছে। সেই ট্র্যাকারও বলছে যে, ভারতে খুব শীঘ্রই মারাত্মক কিন্তু অল্প সময়ের জন্য কোভিডের একটি ঢেউ আসতে চলেছে। এই ট্র্যাকারটিও মে মাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের (Covid 19 2nd Wave) ক্ষেত্রেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। শুধু তা-ই নয়, এই ট্র্যাকার জানিয়েছিল যে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকবে সেই ঢেউয়ের দাপট।
তীব্র কিন্তু অল্প সময়ব্যাপী ঢেউ:
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জাজ বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক পল কাট্টুম্যানের বক্তব্য, ভারতে প্রতি দিনের কোভিডের কেস তীব্র ভাবে বাড়বে। যদিও কোভিড কেসের এই তীব্র বৃদ্ধি কিন্তু খুবই অল্প সময়ের জন্য থাকবে। একটি ই-মেলে তিনি আরও বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই, খুব সম্ভবত এই চলতি সপ্তাহের মধ্যেই নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে।
এ দিকে ট্র্যাকারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২৪ ডিসেম্বরে ৬টি রাজ্যে মারাত্মক ভাবে কোভিডের কেস বেড়ে গিয়েছিল। যা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। আর দু’দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ১১টি রাজ্যে কোভিডের কেস বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, ওমিক্রন মারাত্মক হারে বাড়ছে।
ওমিক্রনের ভূমিকা:
ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্ট মারাত্মক ভাবে বাড়ছে এবং গোটা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতে কোভিড কেস মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে, এমনকী রোজকার নতুন কেসও মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্য, ইতিমধ্যেই প্রায় ২৩টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিডের নয়া ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্ট। আর এই কোভিড কেস আচমকা মারাত্মক ভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টা খুবই উদ্বেগজনক। কারণ ভারতে নতুন করে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার ৭৬৪ জন। যা গত কালের তুলনায় প্রায় ৪৩ শতাংশ বেশি। প্রায় ৬৪ দিন পর কোভিড কেসের সংখ্যা ১৬ হাজারের গণ্ডি অতিক্রম করল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, দেশে এখনও পর্যন্ত ১২৭০টি ওমিক্রন কেস ধরা পড়েছে। তার মধ্যে গত কালের পরিসংখ্যানই ছিল প্রায় ৩০৯। ওমিক্রনের এই ১২৭০টি কেসের মধ্যে সব থেকে বেশি ওমিক্রন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে মহারাষ্ট্রেই। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রে এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশো ওমিক্রন আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। আর দিল্লিতে ৩২০ জন, কেরলে ১০৯ জন এবং গুজরাতে ৯৭ জনের দেহে ওমিক্রনের উপস্থিতির হদিশ পাওয়া গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ৬০ বছরের ওপরে সতর্কতামূলক 'বুস্টার' ডোজ দেওয়ার ঘোষণা! ঠিক কারা কারা পাবেন এই ডোজ?
ওমিক্রন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য:
সাম্প্রতিক একটা আপডেটে জানানো হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) এই নতুন কোভিড ১৯ ভ্যারিয়ান্টের বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে। এই গ্লোবাল স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্টে খুবই ঝুঁকি রয়েছে। আর গোটা দেশে কোভিডের কেস বেড়ে যাওয়ার প্রাথমিক কারণই হল এই নতুন ভ্যারিয়ান্ট। যদিও করোনাভাইরাসের এই নতুন স্ট্রেন খুবই মৃদু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে যে, এই ভ্যারিয়ান্টটি এত বার মিউটেট করেছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মিউটেশনের (Mutation) নিরিখে এটা পিছনে ফেলে দিয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টকেও।
করণীয় পদক্ষেপ:
সবার আগে যেটা করণীয় সেটা হল-- ভ্যাকসিন নেওয়া (Covid Vaccine)। যাঁরা এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে উঠতে পারেননি, তাঁদের অতি শীঘ্রই ভ্যাকসিনের ডাবল ডোজ কমপ্লিট করতে হবে। আর ইতিমধ্যেই ফ্রন্টলাইনারদের এবং প্রবীণদের, যাঁদের কোমর্বিডিটি আর ঝুঁকি বেশি, তাঁদের জন্য বুস্টার ডোজ আনা হচ্ছে। আগামী মাস থেকে শুরু হবে বুস্টার ডোজ দেওয়া এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রেও টিকাকরণ শুরু হয়ে যাবে খুব শীঘ্রই।
এ তো গেল ভ্যাকসিনের কথা! সেই সঙ্গে কোভিড রুখতে যে সব নিয়ম আমরা মেনে চলে আসছি, সেগুলো কঠোর ভাবে মানতে হবে। ভিড়ের মধ্যে যাওয়া চলবে না। তাই বর্ষশেষ এবং বর্ষবরণের আনন্দ রয়ে-সয়ে করতে হবে। বাড়ি থেকে না-বেরেনোরই চেষ্টা করতে হবে। ঘুরতে যাওয়া অথবা বড়সড় জমায়েতে যাওয়ার প্ল্যান থাকলে তা বাতিল করতে হবে। আর বাড়ি থেকে বেরোলে সামাজিক দূরত্ব (Social Distancing) বজায় রাখতে হবে।
শুধু তা-ই নয়, বাড়ির বাইরে পা রাখলে মাস্ক পরা আবশ্যিক। মাস্ক পরলে আপনি নিজেও সুরক্ষিত থাকবেন এবং অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। আর এ ক্ষেত্রে আর একটা বিষয় বলা অত্যন্ত জরুরি। সেটা হল- অনেককেই রঙ-বেরঙের স্টাইলিশ কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে যে, মাস্ক কোনও ফ্যাশন স্টেটমেন্ট নয়। কোভিডের মতো মারণ রোগের হাত থেকে বাঁচতে এটা অন্যতম প্রধান জিনিস। তাই নিজেকে এবং অন্যদের সুরক্ষিত রাখার জন্য পরতে হবে ত্রিস্তরযুক্ত সার্জিক্যাল মাস্ক অথবা ভালো মানের এন৯৫ মাস্ক।
আর সব শেষে যেটা সব থেকে জরুরি, সেটা হল- সংক্রমণ রুখতে বার বার হাত সাবান আর জল দিয়ে ধুতে হবে এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। শুধু বাইরেই নয়, বাড়িতে থাকলেও ঘন-ঘন হাত ধোওয়া অথবা হাত স্যানিটাইজ করা অত্যন্ত জরুরি। টিকা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চললে আপনিও সুরক্ষিত থাকতে পারবেন এবং অন্যকেও সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।