যদিও ওমিক্রনের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হালকা সংক্রমণ হচ্ছে। তবে এই প্রজাতি মারাত্মক হারে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন ভাইরাল স্ট্রেনের প্রাথমিক রিপোর্ট বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
আরও পড়ুন- সব জায়গাতেই এখন মাপা হয় তাপমাত্রা, এই স্ক্রিনিং কি করোনাকে সনাক্ত করতে পারে?
ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনে তিরিশের বেশি মিউটেশন রয়েছে, তাই এটি মনে করা হয় যে এই প্রজাতি টিকা থেকে প্রাপ্ত অনাক্রম্যতা থেকে রক্ষা পেতে পারে। এর ফলে বিদ্যমান কোভিড টিকাগুলি আপডেট করা বা প্রজাতি-নির্দিষ্ট টিকা (Omicron Specific Vaccines) তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
advertisement
মডার্না (Moderna) প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ছিল যারা দাবি করেছিল যে বর্তমানে চালু থাকা টিকাগুলি নতুন প্রজাতির বিরুদ্ধে কম কার্যকর হতে পারে, একই সঙ্গে এটাও ঘোষণা করেছিল যে তারা নির্দিষ্টভাবে ওমিক্রন প্রজাতির জন্য এই বছরের প্রথম দিকে টিকা আনতে চলেছে।
এখন ফাইজার (Pfizer) এবং মডার্না (Moderna) উভয় সংস্থারর সিইও-র মতে, ওমিক্রন প্রজাতিকে টার্গেট করার জন্য বিশেষভাবে দুটি নতুন টিকা শীঘ্রই প্রস্তুত করা হবে। যাই হোক, অনেকেই এই ধরনের টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন, প্রশ্ন করেন যে এটি বিদ্যমান টিকা থেকে কীভাবে আলাদা এবং এটি আদৌ প্রয়োজন কি না।
ওমিক্রন-নির্দিষ্ট বনাম আসল কোভিড টিকা: ওমিক্রন নির্দিষ্ট টিকাগুলি বিশেষভাবে ওমিক্রন প্রজাতিকে টার্গেট করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি, ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ফাইজার-বায়োএনটেক (Pfizer-BioNtech) এবং মডার্না (Moderna) ঘোষণা করেছে যে তারা ওমিক্রন নির্দিষ্ট টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করেছে।
আরও পড়ুন- আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে কীভাবে কাজ করে গুগল!
দুটি টিকাই একই এমআরএনএ (mRNA) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। ওমিক্রন প্রজাতিতে অন্তত ৫০টি মিউটেশন রয়েছে, যা এটিকে প্রথম দিকের করোনাভাইরাসে থেকে আলাদা করে। প্রজাতি-নির্দিষ্ট টিকা তাই মূল টিকা থেকে কিছুটা আলাদা বলে মনে করা হয়।
মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) টিকা মারাত্মক রোগজীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোষগুলিকে সক্রিয় করে একটি ইমিউন প্রতিক্রিয়া শুরু করে। এগুলি কোষকে প্রোটিন বা করোনাভাইরাস স্পাইক প্রোটিনের টুকরো তৈরি করতে নির্দেশ দেয়, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এই কৃত্রিমভাবে তৈরি স্পাইক প্রোটিনগুলো মূল ভাইরাসের মতো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে না।
বর্তমানে ভারতে পরিচালিত কোভিড টিকাগুলি Pfizer এবং Moderna দ্বারা তৈরি করা ভ্যাকসিনগুলির থেকে খুব আলাদা৷ যদিও উভয়ই SARs-COV-2 ভাইরাসকে লক্ষ্য করে, তারা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা খুব আলাদা।
অক্সফোর্ড-অস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন, যা স্থানীয়ভাবে কোভিশিল্ড নামে পরিচিত, সেটি একটি অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর, যা SARS-CoV-2 স্পাইক (S) গ্লাইকোপ্রোটিনকে এনকোড করছে।
ভ্যাকসিনটি মারাত্মক রোগজীবাণুগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে অন্য একটি ভাইরাস ব্যবহার করে। এটি একটি ভেক্টর হিসাবে পরিচিত একটি ভিন্ন ভাইরাসের একটি পরিবর্তিত সংস্করণ ব্যবহার করে একটি ইমিউন প্রতিক্রিয়া ট্রিগার করে।
বর্তমানে ভারতে পরিচালিত কোভিড টিকাগুলি ফাইজার (Pfizer) এবং মডার্নার (Moderna) তৈরি টিকাগুলির থেকে খুব আলাদা। যদিও উভয়ই করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে। তবে, তারা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা খুব আলাদা। অক্সফোর্ড-অস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে কোভিশিল্ড নামে পরিচিত।
কোভিশিল্ড টিকা ভারতে সেরাম ইনস্টিটিউট (Serum Institute of India) তৈরি করছে ভাইরাল-ভেক্টর প্ল্যাটফর্মের উপর ভিত্তি করে। এই জাতীয় টিকাগুলি মানুষের শরীরে ঢোকা ক্ষতিকারক অ্যান্টিজেনক টার্গেট করে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিজেন হল স্পাইক প্রোটিন।
মানুষের শরীরের ভাইরাস নয়, তৈরি হচ্ছে শিম্পাঞ্জির শরীর থেকে নেওয়া এক ধরনের ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইক থেকে। যেটা ধরে নেওয়া হচ্ছে করোনাভাইরাসের মতো। তাই সেটা শরীরে গেলে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে এবং আসল ভাইরাস আক্রমণ করলে শরীরে সেটার সঙ্গে ল়ড়াই করতে পারবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চন্দ্রকান্ত লাহরিয়া বলেছেন যে শিম্পাঞ্জির অ্যাডেনোভাইরাস (Chimpanzee Adenovirus) ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ মানুষের শরীরে এই অ্যাডেনোভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আগে থেকে থাকবে না। তিনি আরও যোগ করেছেন যে বর্তমানে কোভিড টিকাগুলিতে যে অ্যাডেনোভাইরাসগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নন-রিপ্লিকেটিং, যার অর্থ টিকাতে থাকা ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধি করে না।
অন্য দিকে, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের (Indian Council of Medical Research) সহযোগিতায় ভারত বায়োটেক (Bharat Biotech) কোভ্যাক্সিন তৈরি করেছে। এই ধরনের নিষ্ক্রিয় টিকা ভাইরাসের স্ট্রেন থেকে তৈরি হচ্ছে।
যেহেতু এই ভাইরাস মানুষের শরীরে কী ভাবে প্রভাব ফেলে সেটা জানা হয়ে গিয়েছে, তাই রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও সেই অনুযায়ী তৈরি হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ইউএস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মিলকেন ইনস্টিটিউটের মতে, এই টিকা দিয়ে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে মেরে ফেলা হয়েছে (তাপ বা রাসায়নিক দিয়ে), তাই এটি আমাদের অসুস্থ করে তুলবে না।
যাদের শরীরে আগেই থেকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের এই টিকা দেওয়া সবচেয়ে কাজের। এই ধরনের টিকা অন্য টিকার মতো শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে না। তাই অতিরিক্ত ডোজ নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
ওমিক্রন-নির্দিষ্ট টিকা কি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর প্রমাণিত হবে?
ওমিক্রন প্রজাতি সামনে আসার পরই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই প্রজাতির টিকার অনাক্রম্যতাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা তুলে ধরেন। এটি তখনই প্রজাতি-নির্দিষ্ট টিকা তৈরি করা দরকার কি না, তা নিয়ে আলোচনার জন্ম দেয়।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR) দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে এটি পাওয়া গিয়েছে যে ওমিক্রন সংক্রমণের অ্যান্টিবডিগুলি ডেল্টাসহ অন্যান্য প্রজাতির সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। তাই স্বাস্থ্য আধিকারিকরা ওমিক্রন নির্দিষ্ট টিকার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।
তবে, অনেক বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা উপস্থাপন করেছেন। তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন যে এটি সময় এবং প্রচেষ্টার অপচয়। ভাইরাসের নতুন নমুনা এবং স্ট্রেন বার বার আবির্ভূত হওয়ার প্রেক্ষিতে এটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অত্যন্ত কঠিন।
যখন টিকা প্রকৃতপক্ষে চালু হবে ততক্ষণে ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে, এই অর্থে যে সংক্রমণের হার কমে যেতে পারে। কোভিডের ওমিক্রন অত্যন্ত সংক্রামক এবং বেশ কয়েকটি দেশকে প্রভাবিত করেছে। তবে রোগটি এখনও পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি তৈরি করেনি যা হাতের বাইরে।