রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ সারের (Fertilizer) দাম লাগামছাড়া করে দিতে পারে। বিশেষ করে যদি যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়া (Russia) ও ইউক্রেনে (Ukraine) বিশ্বের প্রায় ২৯% গম উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেলের (Sunflower Oil) ৬০ শতাংশই আসে এখান থেকে। ফলে এই ধরনের পণ্যের উৎপাদন কমার জেরে সেগুলির দাম বাড়বে। রাশিয়ার সার উপাদানের প্রাথমিক বাজার হল ব্রাজিল, এস্তোনিয়া, চিন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং লাটভিয়া। এই বিষয়ে হোলসেথার বলেছেন, "ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। যুদ্ধের আগে আমরা ইতিমধ্যেই একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম এবং এখন এটি সরবরাহ শৃঙ্খলে অতিরিক্ত ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। প্রচুর সার সরবরাহ করতে হবে এবং তবে এই সরবরাহ সম্ভবত প্রভাবিত হবে।" রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্যের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী। রাশিয়াও প্রচুর পরিমাণে সারের মূল উপাদন যেমন পটাশ (Potash) এবং ফসফেট (Phosphate) উৎপাদন করে। হোলসেথার বলেন, "সারের জন্য বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা খাদ্য পায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে সার না দিলে ফলন কমে যাবে। সেটা প্রায় ৫০ শতাংশ। আমরা বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের দিকে যাচ্ছি কি না সেটা বিষয় নয়, সঙ্কটটি কতটা বড় হবে সেটাই বিষয়।"
advertisement
ইউক্রেনের রাজধানী কিভে (Kyiv) ইয়ারার অফিসে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। যার কারণে অফিস এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও ১১ জন কর্মী অক্ষত ছিলেন। নরওয়ের সংস্থাটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ফলে সরাসরি প্রভাবিত হবে না। তবে তাদের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জাহাজ চলাচলে ব্যাঘাতের কারণে পণ্য সরবরাহ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞার পাল্টা হিসেবে রাশিয়া সার রফতানি বন্ধ করার কথা জানিয়েছে। হোলসেথার উল্লেখ করেছেন, "ইউরোপীয় খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত মূল পুষ্টির প্রায় এক চতুর্থাংশ রাশিয়া থেকে আসে। বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা চলছে। তবে, এত কময় সময়ে এটা বের করা চ্যালেঞ্জিং।"
আরও পড়ুন: ইউক্রেন আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধ থামবে না, স্পষ্ট বলে দিলেন পুতিন
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে রাশিয়ার এই পদক্ষেপের অর্থ কৃষকদের জন্য খরচ বাড়বে এবং ফসলের ফলন কম হবে। তাতে খাদ্যপণ্যের (Food) দাম বাড়বে। নাইট্রোজেন সারের মূল উপাদান অ্যামোনিয়া (Ammonia) তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাসের (Natural Gas) প্রয়োজন হয়। ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল তার ইউরোপীয় প্ল্যান্টের জন্য প্রচুর পরিমাণে রাশিয়ান গ্যাসের উপর নির্ভর করে। গত বছর, পাইকারি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে ইউরোপে তার ক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন সাময়িকভাবে স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যান্য সংস্থাগুলিও সরবরাহ কমিয়ে দেয়। সরবরাহের খরচ বৃদ্ধি, বেলারুশের (Belarus) উপর নিষেধাজ্ঞা (আরেকটি প্রধান পটাশ সরবরাহকারী) এবং চরম আবহাওয়ার মিলিত সমস্যায় গত বছর সারের দাম বাড়ে। যা সরাসরি খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে।
ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে কীভাবে সরবরাহ বজায় রাখা যায় সে সম্পর্কে এটি প্রতিদিনের মূল্যায়ন করছে তারা। ইয়ারার মালিক বলেছেন, বিশ্বকে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তিনি বলেন, "একদিকে, আমরা কৃষি ফলন ধরে রাখতে কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে আমরা ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানাই।"
ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জগুলির তালিকায় যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, এগুলি সবই অতিমারী শুরু হওয়ার আগে। ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান যুদ্ধকে বিপর্যয়ের শীর্ষে একটি বিপর্যয় হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে ধাক্কা দেবে। তিনি যোগ করেছেন, "যুদ্ধ দরিদ্র দেশগুলিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়াবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে গত দুই বছরে আরও ৫০০ মিলিয়ন লোক বেড়েছে, যারা খালি পেটে রাতে শুয়ে পড়ে। এরপর আবার যুদ্ধ হওয়া সত্যিই উদ্বেগজনক।"
ভারতের উপর প্রভাব:
খনিজ তেল, প্রাকৃতিক মুক্তো ও দামি পাথর, সার, পেট্রপণ্য ও অশোধিত তেল, ভোজ্য তেলের মতো পণ্য রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আনে ভারত, সেগুলির দাম আগামী দিনে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সোমবার অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ (Nirmala Sitharaman) বলেছেন, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে অচলাবস্থার কারণে, বিশেষত রফতানির উপর প্রভাব নিয়ে ভারত আরও চিন্তিত। সীতারমণ জানিয়েছে, সম্ভাব্য প্রভাবের সম্পূর্ণ মূল্যায়ণ করার জন্য মন্ত্রকের মধ্যে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, "আমাদের তাৎক্ষণিক আমদানি এবং ইউক্রেনে আমাদের রফতানির উপর যুদ্ধ কী প্রভাব ফেলতে চলেছে, সে বিষয়ে আমরা ঠিকই চিন্তিত। কিন্তু আমি আরও চিন্তিত আমাদের রফতানিকারকদের নিয়ে,যারা কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।" ইউক্রেনের চলমান সঙ্কটের বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে সীতারমণ বলেছিলেন, "আমরা ইতিমধ্যে একটি জরুরি পরিস্থিতি দেখছি তবে আমাকে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ মূল্যায়ণ করতে হবে এবং তারপরে কেবল এটি সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে।" যদিও, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে ইউক্রেন থেকে আসা ভোজ্য তেলের (Edible Oil) মতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির উপর প্রভাব ফেলতে চলেছে যুদ্ধ। তবে, তিনি অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন যে সরকার আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
আরও পড়ুন: মহাকাশে মহাবিপদ! চিনের রকেটে ক্ষতবিক্ষত হবে চাঁদ! কী হতে চলেছে এর ফলে?
ফেব্রুয়ারিতে, ভারত দীর্ঘমেয়াদে সার সরবরাহের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করেছিল। যদি এই চুক্তিটি হয়ে যেত, তবে ভারত বিশ্বব্যাপী দাম বাড়া সত্ত্বেও কম দামে সার পেত। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ভারত তার সারের চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানির উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্ধেকের বেশি ইউরিয়া আসে অন্য দেশ থেকে। তাই বিশ্বব্যাপী সার সরবরাহের অস্থিরতা ভারতের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে বাধ্য। গত তিন বছরে শুধু রাশিয়া থেকে চার ধরনের সারের আমদানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেগুলি হল-ইউরিয়া (Urea), ডিএপি (DAP), এমওপি (MOP) এবং এনপিকে (NPK)। তবে সরকারি স্তরে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। কানাডা, জর্ডান, লিথুয়ানিয়া, ইজরায়েল এবং জার্মানি-সহ অন্যান্য দেশ থেকে সার আমদানি করা হতে পারে। কিন্তু এই দেশগুলির সক্ষমতা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে আমদানি যেভাবেই হোক প্রভাবিত হতে পারে। ডিএপি-র ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের এক কর্তা বলেছেন, অতীতে সৌদি আরব, মরক্কো এবং চিন (China) থেকে ভারত ডিএপি রফতানি করেছে। কিন্তু চিন ইতিমধ্যেই গত এক বছর ধরে ডিএপি (DAP) রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। তাই ভারতকে মরক্কো, সৌদি আরব এবং জর্ডানের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।
ইউক্রেনের সঙ্কট শুরু হওয়ার সবচেয়ে খারাপ সম্ভাব্য প্রভাব হবে পণ্যের দামের , যা ভারতের জন্য প্রতিকূল দিকে হবে। কারণ এটি মুদ্রাস্ফীতিকে আরও বেশি করে দিতে পারে। ভারত ভোজ্য তেল আমদানির উপর নির্ভরশীল প্রায় ৬০ শতাংশ। ইউক্রেন সূর্যমুখী তেলের অন্যতম প্রধান উৎপাদক। ভারতের সূর্যমুখী তেল আমদানির প্রায় ৭০ শতাংশ ইউক্রেন থেকে, ২০ শতাংশ রাশিয়া থেকে এবং ১০ শতাংশ আর্জেন্টিনা থেকে। জাহাজ চলাচলে প্রভাব পড়ার কারণে আগামী দিনে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে সূর্যমুখী তেল আমদানি কমবে। তাতে ভারতে এই তেলের দাম বাড়বে। অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতির উপর প্রভাব কমাতে তেলের উপর আবগারি শুল্ক কমানোর কথা বলেছেন।
আরও পড়ুন: গোটা বিশ্বের ত্রাস, কোনদিন তাঁকে নাকি দেখা যায়নি! অবশেষে প্রকাশ্যে সেই হাক্কানি নেতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়বে ভারতের চা শিল্পেও (Tea Indistry)। ভারত থেকে বিদেশে যত পরিমাণ চা (Tea) রফতানি হয়ে থাকে তার প্রায় ৪০ শতাংশ যায় রাশিয়া, ইউক্রেন-সহ অন্য দেশগুলিতে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ধাক্কা খেতে পারে চা রফতানি। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেছেন, "অতিমারির মধ্যেই এই যুদ্ধ উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। কারণ রাশিয়া ইউক্রেন ভারতীয় চায়ের একটা বড় অংশের ক্রেতা। আমাদের এখানকার অনেক চা কোম্পানির অফিস রয়েছে রাশিয়া বা ইউক্রেনে। যুদ্ধের ফলে রফতানিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।"