তেল বিপণন সংস্থাগুলির দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের (Brent Crude Oil) দাম রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ধাক্কায় দেশেও জ্বালানির দাম বেড়ে চলেছে। বিশ্ব জুড়ে কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও গত কয়েক মাসে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই মনে হচ্ছে। আর সব চেয়ে মজার বিষয়, বিনামূল্যে করোনা টিকার জন্যই জ্বালানির দাম বাড়ছে বলে দাবি করেছেন পেট্রলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী রামেশ্বর তেলি (Rameswar Teli)। অসমের গুয়াহাটিতে তিনি বলেন, "পেট্রল দামী নয়। আসলে তার উপর কেন্দ্র ও রাজ্যের কর রয়েছে। দেশবাসী বিনামূল্যে কোভিড টিকা পাচ্ছে। টিকার সেই অর্থ কোথা থেকে আসবে? সেই জন্য তেল থেকে আসা করের টাকা টিকা কিনতে কাজে লাগানো হচ্ছে।" একই সঙ্গে বলেন, হিমালয়ান ওয়াটারের দাম পেট্রলের থেকে বেশি।
advertisement
২০২০ সালের ২২ এপ্রিল প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১৬ মার্কিন ডলার। সেই দাম এখন ৮০ মার্কিন ডলার-প্রতি ব্যারেল পার করে দিয়েছে। অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভারতে পেট্রল এবং ডিজেলের দাম সর্বকালীন রেকর্ড ছুঁয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা, টাকার দাম এবং সমস্ত খাতে কম্পানিগুলির খরচের উপর প্রভাব পড়ার ফলে শেয়ারবাজারেও প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
তেলের দাম বৃদ্ধির গ্রাফ:
গত বছরের ২২ এপ্রিল ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১৬ মার্কিন ডলারর কম। ২০২১ সালের শুরু থেকে, এটি প্রায় ৫৮ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৫১.৮ মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায়। এখন দাম ৮১ মার্কিন ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে। গত ছয় সপ্তাহে অপরিশোধিত তেলের দাম রেকর্ড হারে বেড়েছে, বিশেষ করে ২০ অগাস্টের পর থেকে। বিশ্লেষকদের মতে, জ্বালানির দাম ৮৬ মার্কিন ডলারের পৌঁছে যাবে শীঘ্রই।
তেলের দাম বাড়ছে কেন?
কোভিডের গ্রাস থেকে আস্তে আস্তে বিশ্ব অর্থনীতি বেরিয়ে আসার কারণে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে দামও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক তেলের দাম তীব্র বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হল ওপেক+ (OPEC+ ) গ্রুপের দেশগুলি তেল কম উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। অতিমারির কারণে, উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি তেল কম উৎপাদন করছে। যার কারণে তেল এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ইউরোপ ও এশিয়ায় গ্যাসের চাহিদার ঘাটতি রয়েছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেলের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫ দিন তেলের গড় দামের উপরে ভারতে পেট্রল ও ডিজেলের দাম ঠিক করা হয়। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের উচ্চ হারে করের কারণেও ভারতে জ্বালানির খুচরো মূল্য অনেক বেশি হচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ট্যাক্স ছাড়াও তেলের দামের সঙ্গে যুক্ত থাকে ডিলারের কমিশন। ট্যাক্সের মধ্য যুক্ত থাকে কাস্টমস ডিউটি, এক্সাইজ ডিউটি এবং রাজ্য সরকারের ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (VAT)।এখনও পর্যন্ত পেট্রোল ও ডিজেলের কাস্টমস ডিউটি ২.৫ শতাংশ।
জ্বালানির দাম বাড়ার প্রভাব:
- যেহেতু ভারত তার জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করে, তাই অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য আরও ডলারের প্রয়োজন হয়, যার ফলে লিকুইডিটি কমে যায়।
- টাকার মূল্য প্রতি ডলারে ৭৫ টাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম আরও বাড়বে।
- কয়লার সাপ্লাই চেইন কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের চাহিদা বেড়েছে।
- অশোধিত তেল ভারতের মোট আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ।
- জ্বালানির আমদানি বিল ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে ছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। সেটা ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে বেড়ে হয় ২৪.৭ বিলিয়ন ডলারে।
- জ্বালানির দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে, আরবিআইকে নানা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হয়।
- অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার অর্থ হল বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি।
- অপরিশোধিত তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি ভারতের ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং আর্থিক ঘাটতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
- মূল্যবৃদ্ধি চলতি হিসাবের ঘাটতিকে প্রভাবিত করে, যার অর্থ আমদানিকৃত পণ্য ও পরিষেবার মূল্য রফতানির চেয়ে বেশি।
- ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দামের তীব্র বৃদ্ধি ইক্যুইটি মার্কেটে স্বল্পমেয়াদী আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে।
- গত বছর অতিমারির চরম সময়ে, তেলের ভবিষ্যত নেতিবাচক হয়ে যায় এবং শেয়ার বাজারে পতন দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে শেয়ার বাজারও চাঙ্গা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপক্ষে পাঁচটি বিষয় রয়েছে যা জ্বালানির চূড়ান্ত খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে। এর মধ্যে রয়েছে মূল কাঁচামাল এবং অপরিশোধিত তেলের দাম, ভারতীয় টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার, পরিশোধনের খরচ, সরকারি কর এবং চাহিদার মাত্রা।
ভারতীয় টাকার পতন কী ভাবে জ্বালানির দাম বাড়ায়?
ভারত তার জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে আরব, আমেরিকা-সহ অন্যান্য ইউরোপের দেশ থেকে। তেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলারে কেনা হয়, যার অর্থ মার্কিন ডলারের (US dollar) বিপরীতে ভারতীয় টাকার (Indian rupee) বিনিময় হার সরাসরি প্রভাব ফেলে। তেলের দাম কম থাকলেও ডলারের তুলনায় টাকার দাম কম থাকলে তেল কিনতে বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়ে।
শক্তিশালী ডলারের অর্থ হল আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না বদলালেও ভারতকে একই পরিমাণ তেলের জন্য বেশি মূল্য দিতে হবে। সুতরাং, ডলারের মূল্য যত বেশি হবে, আমদানিকারকদের অপরিশোধিত তেলের জন্য বেশি অর্থ দিতে করতে হবে। টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি সিএনজি-র পাশাপাশি পাইপযুক্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়িয়ে দেয়।
ভারতের তেলের মোট চাহিদার একটি বড় অংশ ইরান থেকে আসে। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতকে টাকা ভিত্তিক পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে তেল আমদানি করতে হবে। তেল আমদানির জন্য পেমেন্টের ৫০ শতাংশ অর্থ সরাসরি দিতে পারবে ভারত। বাকি ৫০ শতাংশ দিতে হবে ঘুরপথে। ইরানে ভারত চাল, ইস্পাত, চা ও ওষুধ রফতানি করে। এই পণ্যগুলির পেমেন্টের ক্ষেত্রে তেলের জন্য ভারতের বাকি থাকা দাম ব্যবহার করবে ইরান। তাও পেমেন্ট করা হবে রফতানিকারকদের। ইরান থেকে ভারতের প্রধান আমদানি করে অপরিশোধিত তেল, সেটা ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতের মোট তেলের চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করত ইরান। মাস ছয় আগে ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ভারত। যার কারণে দাম কমতে শুরু করে। ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে ভারতীয় রফতানিকারকরা পেমেন্ট সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করেছিলেন।