যথাযথভাবে চিকিৎসা না হলে মারাত্মক ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। ডেঙ্গুর কোনও টিকা এখনও পর্যন্ত সহজলভ্য নয়। টিকা সহজলভ্য থাকলে সত্যিই ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোখা যেত অনেকাংশেই ও সম্ভাব্য ঝুঁকি কমে যেত। এছাড়াও, কোভিডের মধ্যেই ডেঙ্গুর উপসর্গ সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা আরও জটিল করে তুলছে। জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, পেশিতে ব্যথা এবং ফুসকুড়ি ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ। এই রোগটি খুব কমই মারাত্মক। কিন্তু চিকিৎসায় দেরি হলে তা ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর (Dengue Hemorrhagic Fever) নামে পরিচিত আরও গুরুতর অবস্থায় পরিণত হতে পারে।
advertisement
D2 ডেঙ্গু কী?
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত জ্বর। প্রকৃতপক্ষে, এটি মশা থেকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভাইরাল রোগ। রোগটি বেশিরভাগ ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ুতে বিস্তার লাভ করে। প্রধানত শহর এবং শহরতলি অঞ্চলে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। যদিও এটি ডেঙ্গু ভাইরাস, যার নাম DENV, যা এই রোগের মূল কারণ। এছাড়াও আরও চারটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ফর্ম রয়েছে। এই চারটি সেরোটাইপ হল- ডিইএনভি ১ (DENV-1), ডিইএনভি ২ (DENV-2), ডিইএনভি ৩ (DENV-3), ডিইএনভি ৪ (DENV-4)। এর মানে হল যে ডেঙ্গু একজন ব্যক্তিকে চারবার আক্রান্ত করতে পারে। যদিও একবার একটি স্ট্রেনে সংক্রমিত হলে সাধারণত সেই স্ট্রেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অনাক্রম্যতা অর্থাৎ ইমিউনিটি তৈরি হয়। তবুও বাকি তিনটি স্ট্রেইনে সংক্রমিত হওয়া সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অনেক DENV সংক্রমণ শুধুমাত্র হালকা অসুস্থতা তৈরি করে, কখনও কখনও আবার তীব্র ফ্লু-এর মতো অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। জ্বর বা সেই সম্বন্ধীয় কিছু অসুস্থতা হয়। তবু মাঝে মাঝে এটি একটি প্রাণঘাতী জটিলতায় পরিণত হয়, যাকে বলা হয় মারাত্মক ডেঙ্গু। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে ইন্ডিয়ান কউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR)-র ডিরেক্টর বলরাম ভার্গব জানিয়েছেন যে ডেঙ্গুর DENV-2 বা D2 ভ্যারিয়ান্ট পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদ, আগ্রা, মথুরা এবং আলিগড় জেলায় জ্বর ও মৃত্যুর পিছনে অন্যতম কারণ। তিনি এও বলেন যে এই স্ট্রেনটি মারাত্মক ক্ষতিকারক।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর কী?
ডেঙ্গু ফ্ল্যাভিভিরিডে পরিবারের একটি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। চারটি ভাইরাস রয়েছে যেগুলি সেরোটাইপস জাতীয়। সেগুলি হল ডিইএনভি ১, ডিইএনভি ২, ডিইএনভি ৩ এবং ডিইএনভি ৪। এই ভাইরাসগুলিই প্রধানত ডেঙ্গুর জন্য দায়ী। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপে সংক্রমণ হলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু অন্য সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সংক্রমণ থেকে সেড়ে ওঠার পরেও আবার কয়েকজনের জ্বর আসে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের উপসর্গ কী কী?
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের উপসর্গগুলি সাধারণ ডেঙ্গুর উপসর্গের থেকে আলাদা।
উপসর্গগুলি হল- ত্বকের নিচে রক্তপাত, ঘন ঘন বমি হওয়া, পেটে ব্যথা, হালকা, মাঝারি বা ধুম জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, পেশি, হাড় বা জয়েন্টে ব্যথা, ত্বকে ফুসকুড়ি
সাধারণ ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর হেমোরেজিক জ্বর হতে পারে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যে যে উপসর্গের দিকে নজর রাখা উচিত- অস্থিরতা, তীব্র বা হঠাৎ জ্বর, সাংঘাতিক পেটে ব্যথা, ত্বকের নিচে রক্তপাত বা ক্ষত, ঠাণ্ডা বা আঠালো ত্বক, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে কাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু যে কোনও ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অসাবধানতা, চিকিৎসায় দেরি হলে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের। এছাড়াও বয়স্ক ব্যক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, তারাও এতে আক্রান্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন- শরীরে ক্যালসিয়ামের সমস্যা? সঠিক সময়ে না ধরতে পারলে বড় সমস্যায় ভুগবেন!
চিকিৎসা কী?
জ্বর কমানো এবং পেন কিলার ব্যবহার করা যেতে পারে। ডেঙ্গুর উপসর্গগুলির চিকিৎসার সর্বোত্তম বিকল্প হল অ্যাসিটামিনোফেন বা প্যারাসিটামল। নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস যেমন আইবুপ্রোফেন এবং অ্যাসপিরিন না ব্যবহার করাই ভালো। এই ওষুধগুলি রক্তকে পাতলা করে দেয় এবং রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। মারাত্মক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক এবং নার্সদের তৎপরতায় জীবন বাঁচানো যেতে পারে। মৃত্যুর হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যায়। গুরুতর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরের তরল ভলিউম সব সময় ঠিক রাখা উচিত। জ্বর ও অন্য উপসর্গের তীব্রতার উপর চিকিৎসা নির্ভর করে। নিম্নলিখিত চিকিৎসা বিকল্পগুলির মধ্যে একটি বা দু'টি বেছে নেওয়া যায়। এই সমস্ত পদ্ধতিগুলি ডেঙ্গুর উপসর্গগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এর পর ধীরে ধীরে শরীর সুস্থ হয়ে যায়।
ব্যথা কমানোর ওষুধ
ইলেক্ট্রোলাইট থেরাপি
রক্ত সঞ্চালন
অক্সিজেন থেরাপি
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে?
এটি মনে রাখা উচিত যে ডেঙ্গু একটি সংক্রমণ হিসাবে রয়ে গিয়েছে যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মূল করা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত ভালো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণ রূপে এড়ানো যায়। দরজা, জানালার পর্দা, প্রতিষেধক, কীটনাশক সামগ্রী, কয়েলের ব্যবহার করতে হবে। ত্বকের সংস্পর্শে যাতে মশা কম আসতে পারে এমন পোশাক অবশ্যই পরতে হবে। প্রাদুর্ভাবের সময় স্প্রে হিসাবে কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মশা ডিম পাড়তে পারে এমন জায়গায় নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে। খোলা পাত্রে জল জমতে দিলে হবে না। এজন্য নিয়মিত নজরদারি করতে হবে।
আরও পড়ুন - শিশুরা করোনার সুপারস্প্রেডার হতে পারে, কেন এমন বলছে সমীক্ষা?
গত কয়েক দশকে বিশ্বে ডেঙ্গুর প্রকোপ নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন বা হালকা উপসর্গ থাকছে। তাই ডেঙ্গুর প্রকৃত সংখ্যা কম রিপোর্ট করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য জ্বরজনিত অসুস্থতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। অনুমান প্রতি বছর ৩৯০ মিলিয়ন ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়। যার মধ্যে ৯৬ মিলিয়ন ক্লিনিক্যালি সামনে আসে। ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ে আরেকটি গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যে ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশ্বের ১২৯টি দেশে সংক্রমণের এই ঝুঁকি রয়েছে। যার মধ্যে ৭০ শতাংশ দেশ এশিয়ার। গত দুই দশকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আটগুণ বেড়েছে।