পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সংক্রমণ। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ (Rajesh Bhushan) সম্প্রতি জানান, ভারতে এখনও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, দ্বিতীয় ঢেউ এখনও দেশ থেকে বিদায় নেয়নি। তবে, প্রতিবারই যখন ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন দেখা দেয়, তখন আমরা টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। কারণ, আমরা দেখি যে টিকা দেওয়া ব্যক্তিরাও সংক্রমিত হয়েছেন। টিকা নিয়ে নানা ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এর ফলে টিকাকরণের শুরুর দিকে অনেকেই করোনা টিকা নিতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে সেই সব ভুয়ো তথ্য ঠেকানো অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করছেন এই ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানোর ফলে, অনেকেই করোনা ভ্যাকসিন নিতে রাজি হচ্ছেন না। যার ফলে করোনার সঙ্গে যুদ্ধে অনেকটাই পিছিয়ে যেতে হচ্ছে।
advertisement
আসলে এটা এই মুহূর্তে বোঝা অবশ্যই দরকার যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এখনও অনেক দূরে যেতে হবে। হালকা ভাবে নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার পরও অনেকে দেশে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অনেক দেশের সীমান্তও খুলছে না। আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ পাবলিক হেল্থ-এর ডিন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ আশিস ঝা (Dr Ashish Jha) সম্প্রতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা কোভিড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
আরও পড়ুন: করোনা সারলেও থেকে যাচ্ছে কিছু সমস্যা! লং কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি
টিকা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ:
টিকার কার্যকারিতা এবং এর পরের প্রভাব সম্পর্কে অনলাইনে প্রচুর ভুল তথ্য পাওয়া যায়। টিকা নিলে না কি মহিলাদের মাসিক চক্রে পরিবর্তন আসতে পারে, বন্ধ্যাত্বের সমস্যা হতে পারে, রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, ইত্যাদি নানা মিথ রয়েছে। যে কারণে অনেকেই টিকা নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এছাড়া, এমন খবরও রয়েছে যে বর্তমানে সারা বিশ্বে যে টিকা দেওয়া হচ্ছে তা মিউট্যান্ট ভাইরাসের (পরিবর্তনশীল) ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর নয়। আমাদের যা বোঝা দরকার তা হল এই সময়ে, সংক্রমণের ঝুঁকি এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা কমাতে একমাত্র উপায় টিকা (Covid 19 Vaccine)। টিকা দেওয়া কেবল সংক্রামক ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমাদের আশেপাশের অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ। টিকা নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
বিধি মেনে চলা:
দ্বিতীয়ত, এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে অতিমারী শেষ হয়নি। তাই একে হালকা ভাবে নেওয়ার কোনও জায়গা নেই। অতিমারী নিয়ন্ত্রণের জন্য চারটি জিনিস অপরিহার্য, তা হল টিকা, পরীক্ষা, মাস্ক পরা এবং ঘরের মধ্যে আলো-বাতাস ঢোকা। টিকা দেওয়ার পাশাপাশি যতটা বেশি সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করা উচিত। তাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমে। এই সময়ে কোভিড বিধি মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, করেনাার ডেল্টা (Delta Variant), আলফার (Alpha Variant) মতো অনেক রূপের কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন: ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও কেন অনেকের শরীরে কোভিড আক্রমণ করছে?
হার্ড ইমিউনিটির ধারণা:
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হার্ড ইমিউনিটির (Hard Immunity) ধারণাটি এখন সরিয়ে রাখা। এই ইস্যুতে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু, হার্ড ইমিউনিটি বলা যতটা সহজ, ততটা পাওয়া সহজ নয়। অনেকেই মনে করেন যে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার থেকে প্রাকৃতিক উপায় মেনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ালে তা ভালো। কারণ হিসাবে তাঁদের যুক্তি, করোনা ভ্যাকসিন নিলে পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানীদের যুক্তি এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে টিকা নেওয়ার পর পরবর্তীতে কোনও বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে। তাঁরা জানিয়েছেন, করোনাকে হারানোর যে পরিমাণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রয়োজন তা টিকার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ভাইরাস থেকে ইমিউনিটি কেবল দু'টি উপায়ে অর্জন করা যায়- টিকা বা সংক্রমণ। জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে এখনও টিকা দিতে হবে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। যার অর্থ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি এবং মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেশি। মৃত্যুর হার কমানোর জন্য টিকা থেকে ইমিউনিটি অর্জন করাটা সংক্রমণের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
এই তিনটি জিনিস ছাড়াও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, যতটা সম্ভব ঘরের মধ্যে থাকা, মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও গুরুত্বপূর্ণ। যতটা সম্ভব জমায়েত এড়িয়ে চলতে হবে। রেস্তোরাঁ, ফিটনেস ক্লাস, নাইটক্লাব, মন্দির-মসজিদে যেতে হবে ভিড় এড়িয়ে। সব চেয়ে বড় কথা, শিশুদের টিকা না আসা পর্যন্ত আমাদেরকেই তাদের রক্ষা করতে হবে। তাই করোনাকে এখনও হালকা ভাবে নিলে চলবে না। হালকা ভাবে নেওয়ার কারণে ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ আমরা দেখেছি। অক্সিজেনের চাহিদা, বেডের আকাল, সবই আমাদের নজরে এসেছে। তাই কোনও ভাবেই এখনও করোনাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। এর জন্য যা পদক্ষেপ নেওয়ার নিতে হবে, বিধি মেনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন: Covid 19-র পাশাপশি Viral Fever-র প্রকোপ বাড়ছে, যে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবে...
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে যে দেশের মোট প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ টিকার অন্তত একটি ডোজ পেয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ২৩ শতাংশকে ২টি টিকা দেওয়া হয়েছে। লক্ষদ্বীপ, চণ্ডীগড়, গোয়া, হিমাচলপ্রদেশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং সিকিমের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে কমপক্ষে টিকার একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে। জানা যাচ্ছে, আগামী মাস থেকেই দেশে ১২-১৮ বছর বয়সীদের টিকাকরণ শুরু হবে। ভারতে ইতিমধ্যেই জাইডাস ক্যাডিলার (Zydus Cadila) জাইকোভ-ডি (ZyCov-D) টিকার জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভারতে শিশুদের জন্য একমাত্র এই টিকা অনুমোদিত হয়েছে। জাইডাস ক্যাডিলা জানিয়েছে, অক্টোবর থেকে তারা মাসে ১০ মিলিয়ন ডোজ টিকা উৎপাদন করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ৮৪ কোটি ৮৯ লাখ ২৯ হাজার ১৬০ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে গতকাল দেওয়া হয়েছে ৭১ লাখ ৪ হাজার ৫১ ডোজ।
