মস্কোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেনকে কাছে টানা ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এক সপ্তাহ আগেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলেদিমির জেলেনস্কি (Volodymyr Zelenskyy) ইউরাপীয় ইউনিয়নে (European Union) যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধে স্বাক্ষর করেছেন। ফ্রান্সের (France) রাজধানী প্যারিসের (Paris) কাছে ভার্সাই প্রাসাদে বৈঠকে বসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা সেই আবেদন গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও তাঁরা ইউক্রেনকে সদস্যপদ দিতে রাজি হয়েছেন বলেও খবর। যদিও এই সদস্যপদ দ্রুত দেওয়া হবে না বলেই আরও খবর। বৈঠকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি।
advertisement
জেলেনস্কি মঙ্গলবার ইউরোপীয় সংসদে ভাষণে বলেছিলেন, "ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের সঙ্গে নিয়ে আরও শক্তিশালী হতে চলেছে। সুতরাং এটি নিশ্চিত।" যদিও চাপের মুখে তিনি বলেন, "ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা প্রমাণ করুন যে আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন। প্রমাণ করুন যে আপনারা আমাদের যেতে দেবেন না। প্রমাণ করুন যে আপনারা সত্যিই ইউরোপীয়।"
আরও পড়ুন: অতীতে ধ্বংস হয়েছে হিউম্যান করিডর! এবার কি রক্ষা পাবেন ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকরা?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্যাকে আরও জটিল করেছে মলদোভা (Moldova) এবং জর্জিয়া (Georgia)। রাশিয়ার আগ্রাসনের আশঙ্কায় থাকা এই দুটি ছোট দেশ ইউক্রেনের রাস্তায় হেঁটেছে। তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ চেয়েছে। রুশ আগ্রাসন ও হিংসা সুইডেন (Sweden) এবং ফিনল্যান্ডের (Finland) মতো ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ দেশগুলিকেও আতঙ্কিত করেছিল। এই দেশগুলিতে ন্যাটো (NATO)-তে যোগ দেওয়ার আওয়াজ উঠেছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে মহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নড়ে গিয়েছে। সুযোগের রোমাঞ্চ সত্ত্বেও অগ্রগতি ধীর হতে পারেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
অনেক দেশই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃদ্ধি মহাদেশটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে আরও ঠেলে দেবে। ইউক্রেন যোগ দিলেই ইউরোপে ব্লকের ভারসাম্যকে খানিকটা কাত হয়ে যেতে পারে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল (Charles Michel) ভার্সাই সম্মেলনে (Versailles Summit) তাঁর আমন্ত্রণ পত্রে লিখেছিলেন, "ইউক্রেনের সঙ্গে আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছি। ইউক্রেন আমাদের ইউরোপীয় পরিবারের অংশ।" অর্থাৎ, তিনি কোথাও সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর কথা আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ করেননি। এমনকী যদি ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি ঐক্যমত্য হয়, তবে সদস্যপদ দেওয়া এই পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় বা এমনকি ইচ্ছাপূরণ ছাড়া কিছুই নয়।
আরও পড়ুন: হঠাৎ করেই আসরে, কেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে ইজরায়েল?
আটটি পূর্ব সদস্য দেশের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন এস্তোনিয়ান প্রধানমন্ত্রী কাজা ক্যালাস (Kaja Kallas)। বুধবার তিনি স্ট্রাসবার্গে ইউরোপীয় সংসদে ভাষণ দিয়েছেন। ক্যালাস জোরের সঙ্গে বলেছেন, "ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া কেবল আমাদের স্বার্থেই নয়, এটি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও। ইউক্রেন তাদের জন্য যুদ্ধ করছে না। তারা ইউরোপের জন্যও লড়াই করছে। যদি এখন না হয় তো কখন হবে?"
কিন্তু একই সময়ে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট (Mark Rutte) স্পষ্ট করেছেন যে ইউক্রেনকে এখনই সদস্যপদ দেওয়া যাবে না। গত সপ্তাহে জেলেনস্কির আবেগপূর্ণ বক্তব্যের পরে রুট মঙ্গলবার ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই বিষয়টি তুলে ধরে রুট বলেন, "আমি তাঁকে বলেছিলাম যে আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জানি, তবে এটি স্বল্পমেয়াদে ঘটবে না কারণ এটি একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, যা অনেক বছর সময় নেয়। সুতরাং দেখা যাক আমরা এখন এবং আগামীকাল এবং পরের সপ্তাহে বা পরের মাসে কী করতে পারি।" তিনি জোর দিয়েছিলেন যে মলদোভা এবং জর্জিয়ার সদস্যপদ পেতে আরও সময় লাগবে। কারণ তারা ইউক্রেনের মতো হুমকির মুখোমুখি নয়।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পাওয়েল জেরকা (Pawel Zerka) বলেন, "ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা সহজেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।" অতীতে, সদস্যপদ আবেদনের জন্য কয়েক বছর, কখনও কখনও কয়েক দশক লেগেছে। তুরস্ক (Turkey) ১৯৮৭ সালে যোগদানের জন্য আবেদন করেছিল এবং তারাও এখনও সদস্য পদ পায়নি। চারটি দেশের আবেদন এখনও ঝুলে রয়েছে। তবে ইইউ আরও পূর্ব দিকে প্রসারিত করতে চরম অনিচ্ছা দেখিয়েছে। ইউক্রেনের সদস্যপদ মেনে নিলে অন্যরা সেটা ভাল চোখে নেবে না। এছাড়াও সম্ভাব্য নতুন সদস্যদের আইনের শাসনের নীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য এবং সারের মান-সহ প্রায় ৮০ হাজার পাতার নিয়মগুলি মেনে নিতে হবে। বিগত বছরগুলিতে ইইউ প্রায়শই উল্লেখ করেছে যে ইউক্রেনের দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলি সেইভাবে কার্যকর নয়। সদস্যপদ পেতে গেলে বর্তমান সদস্যদের সর্বসম্মত অনুমোদনের প্রয়োজন। এখানে একটি দেশও তাদের আপত্তি জানাতে পারে।
তুলনামূলকভাবে, ন্যাটো সদস্য পাওয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া সহজ, বিশেষ করে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলির জন্য। যেহেতু ইতিমধ্যেই সামরিক জোটের সঙ্গে উভয় দেশেরই খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে। যদিও একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ অবশ্যই মস্কোর ক্রোধ বাড়িয়ে দেবে এবং একটি ভূ-রাজনৈতিক শক্তির খেলা হিসাবে দেখা হবে। রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, "এটি স্পষ্ট যে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, যা সর্বপ্রথম একটি সামরিক সংস্থা, তাহলে এটি গুরুতর সামরিক-রাজনৈতিক পরিণতি ঘটাবে, যার জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের দ্বারা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে।"
কিন্তু, একরকম, যে নর্ডিক নিরপেক্ষতা ইতিমধ্যে স্খলন হতে পারে.
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের এড আর্নল্ড বলেছেন, "সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড কার্যকরভাবে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সুইডেনের ক্ষেত্রে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠানো প্রাণঘাতী পদক্ষেপ।"
এখন পরিস্থিতি কী?
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুক্রবার ১৭তম দিনে পড়েছে। আজ সকালে আক্রমণের তেজ বাড়িয়েছে রাশিয়া। কিভের বাইরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনার মধ্যে প্রবল লড়াই চলছে বলে খবর সংবাদ সংস্থা সূত্রে। কিভে প্রবল বোমাবর্ষণেরও অভিযোগ রুশ সেনার বিরুদ্ধে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, শনিবার ভোরে ইউক্রেনের বেশিরভাগ শহরে বিমান হামলার সাইরেন শোনা গিয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে একাধিক পড়শি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন বহু নাগরিক। যুদ্ধের কারণে কুড়ি লাখেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গোয়েন্দা তথ্য জানিয়েছে যে রাশিয়ার স্থল বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ এখন কিভ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। দুই বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। কিভের একাধিক জায়গায় আগুন লেগে গিয়েছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি জানিয়ছে কিভ থেকে ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে ভ্যাসিলকিভে একটি তেল ডিপোতে আগুন লেগেছে। ইউক্রেনের ব্রোভারি এলাকায় একটি প্রক্রিয়াজাত খাবারের কারখানাতেও আগুন লেগেছে। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক (Iryna Vereshchuk) বলেছেন যে শনিবার মারিউপোল থেকে জাপোরিঝিয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মানবিক করিডোর (Humanitarian Corridors) খোলা রয়েছে। অন্তত ১০টি মানবিক করিডোর খোলার কথা জানিয়েছে রাশিয়াও।
ঘুরপথে ইউক্রেনকে সাহায্য করেছে আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক দেশ। রাশিয়াকে আর্থিকভাবে ধাক্কা দিতে একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে। রাশিয়া (Russia) থেকে কয়লা (Coal), তেল (Oil) ও গ্যাস (Gas) আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Ban) জারি করেছে আমেরিকা (United States)। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আমেরিকার কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল, নির্দিষ্ট পেট্রোলিয়াম পণ্য, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা নতুন করে কিনতে পারবে না। এছাড়াও আমেরিকান কোনও সংস্থা রাশিয়ায় পাওয়ার সেক্টরে (Power Sector) বিনিয়োগ করতে পারবে না। গতকাল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন রাশিয়া ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র (Chemical Weapons) ব্যবহার করতে পারে। যদিও প্রথমে রাশিয়ার তরফেই সম্প্রতি বলা হয়েছিল যে ইউক্রেন রাসায়নিক হামলার পরিকল্পনা করছে। যদিও জেলেনস্কি জানান যে ইউক্রেন কোনও জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র বা অন্য ধরনের কোনও বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেনি।
ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় জেলেনস্কি বলেন, "আমি একটা উপযুক্ত দেশের প্রেসিডেন্ট। সেই সঙ্গে দুই সন্তানের বাবা। আমার দেশে মানব সম্পদের চরম ক্ষতিকারক কোনও রাসায়নিক অস্ত্র বা বায়োলজিক্যাল অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হয় না। রাশিয়া যে এই ধরনের কাজ করে, তা গোটা বিশ্ব জানে। রাশিয়া যদি আমাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে তাহলে ফল মারাত্মক হবে।"