#নয়াদিল্লি: রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ (Russia-Ukraine War) থামাতে উদ্যোগী হলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট (Naftali Bennett)। শনিবার তিনি মস্কোতে (Moscow) গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) সঙ্গে দীর্ঘ তিনঘণ্টা ধরে কথা বলেন। তারপর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির (Volodymyr Zelenskyy) সঙ্গেও তাঁর ফোনে কথা হয়। মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর বার্লিনে (Berlin) আসেন বেনেট। জার্মানির চ্যান্সেলার ওলাফ শোলজের (Olaf Scholz) সঙ্গে তিনি দেড়ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন।
কিন্তু, যুদ্ধের মাঝে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ঢোকা ইজরায়েলের (Israel) জন্য মাইনফিল্ড (Minefield) হতে পারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক আছে ইজরায়েলের। তাছাড়া রাশিয়া সিরিয়া (Syria) যুদ্ধের সঙ্গেও জড়িত। সিরিয়া আবার ইজরায়েলের প্রতিবেশী দেশ। তাই সিরিয়ায় নিরাপত্তা উদ্বেগের ইস্যুটি ক্রেমলিনের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। এছাড়াও ইজরায়েল প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রাগানোর সামর্থ্য রাখেন না। দুই পক্ষকে যুদ্ধ থামাতে রাজি করাতে পারলে বেনেট একজন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে উঠে আসবেন। প্যালেস্তাইন (Palestine) ইস্যুতেও ইজরায়েলের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলবেন।
বেনেটের বাজি: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে (Benjamin Netanyahu) সরিয়ে গত বছর বেনেট ক্ষমতায় এসেছিলেন। ধর্মীয়ভাবে ইহুদি বেনেট দেশের হাই-টেক সেক্টরে বহু অর্থ উপার্জন করেছেন, বেনেট অতীতে বিভিন্ন মন্ত্রিসভার পদে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর পূর্বসূরির মতো ক্যারিশমা এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং পুতিনের মধ্যে মধ্যস্থতা করা তাঁর জন্য বড় পরীক্ষা, যা আগে কখনও হয়নি। এমনিতেই ঘরোয়া রাজনীতিতে বিরোধীরা বেনেটের শাসনকে অবৈধ হিসাবে দেখে। বেনেটকে যেভাবে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল, বিরোধীরা তার তীব্র প্রতিবাদ করেছে। বিরোধীদের আরও দাবি, জনমত বেনেটের পক্ষে ছিল না। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা না করার জন্যও নিজের দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। যদিও বেনেট বারবার ইউক্রেনের জনগণের প্রতি তাঁর সমর্থন প্রকাশ করেছেন, তবে তিনি রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা করা থেকে বিরত ছিলেন।
রাশিয়ার উপরে পশ্চিমা দেশগুলির নিষেধাজ্ঞা চাপানো শুরু হতেই বেনেট পুতিন এবং জেলেনস্কি, উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। জেলেনস্কিই যুদ্ধ থামাতে রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতা শুরু করতে বলেছিলেন বেনেটকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনিই একমাত্র পশ্চিমা নেতা যিনি রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বিশ্ব রাজনীতিতে অপরীক্ষিত বেনেট রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে নাক গলিয়ে ইজরায়েলকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন। যুদ্ধরত দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনা তার জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে। এক কথায় তিনি বাজি ধরেছেন, জিতে গেলে বেনেট তাঁর রাজনৈতিক ভাগ্যকে আরও প্রাণবন্ত করতে পারেন।
আরও পড়ুন: ২০২৪-এর মধ্যে তৃণমূলের 'এই' পরিণতি! সুকান্ত মজুমদারের হুঁশিয়ারিতে শোরগোল
তেল আভিভ ইউনিভার্সিটির ইউরোপীয় বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এথার লোপাটিন (Esther Lopatin) বলেন, "বেনেট নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। যিনি ভোট নিয়ে বিরোধীদের, জনসাধারণের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে তিনি তার টুপি থেকে খরগোশ টেনে বের করতে পারেন।"
কূটনৈতিক সম্পর্ক: রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক রয়েছে এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে ইজরায়েল অন্যতম। ইউক্রেনে ১০০ টন মানবিক সহায়তা (Humanitarian Aid) প্রদান করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে তারা সেখানে একটি ফিল্ড হাসপাতাল (Field Hospital) স্থাপন করবে। ইউক্রেনও প্রায় ২ লাখ ইহুদির আবাসস্থল, যাদের মধ্যে বহু মানুষ ইতিমধ্যেই ইজরায়েলে পালিয়ে গেছে, আরও অনেকই পালিয়ে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বেনেট তাঁর মন্ত্রীদের বলেছেন যে রাশিয়ার আক্রমণ থেকে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয় ইহুদি উদ্বাস্তুদের জন্য ইজরায়েলকে অবশ্যই তার দরজা ও হৃদয় উন্মুক্ত করতে হবে। কারণ, যুদ্ধ এখনই শেষ হচ্ছে না।
রাশিয়ার সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ায় কারণে ইজরায়েল রাশিয়ার উপর নির্ভর করে। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি রয়েছে এবং যেখানে ইজরায়েলি জেটগুলি প্রায়শই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। ভিয়েনায় ইরানের (Iran) পারমাণবিক কর্মসূচি (Nuclear Program) নিয়ে আলোচনায় অন্য দেশগুলির মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। এই চুক্তি দ্রুতই স্বাক্ষর হবে বলে মনে করা হয়েছে। ইজরায়েল এই চুক্তির বিরোধিতা করে বলেছে যে এটি ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমকে পর্যাপ্তভাবে রোধ করবে না। অতীতে তাদের এই বিরোধিতার বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে প্রায়শই আলোচনা করেছে তেল আভিভ।
মধ্যস্থতা করতে হলে ইজরায়েলকে ধীরে সুস্থে পা ফেলতে হবে, নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে হবে। যে কোনও ভুল পদক্ষেপ পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। আলোচনা ব্যর্থ হলে পুতিনের ধূর্ততার কারণে বেনেট বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন বলে মনে হতে পারে। পরিস্থিতি জটিল করার জন্য তাঁকে দায়ী করা হতে পারে। পশ্চিমা-মিত্র দেশগুলির মধ্যে ইজরায়েলই একমাত্র যারা মস্কোর প্রতি প্রকাশ্যে শত্রুতামূলক বক্তব্য প্রকাশ করেনি।
আরও পড়ুন: বড় বিপদে অনুব্রত মণ্ডল, অনেক চেষ্টাতেও হল না শেষরক্ষা!
সাফল্যের সম্ভাবনা?
মস্কো সফর থেকে ফিরে আসার কয়েক ঘন্টা পরেই বেনেট তাঁর মন্ত্রিসভাকে বলেছিলেন যে সুযোগ কম থাকলেও মধ্যস্থতার (International Mediation) করা ইজরায়েলের জন্য নৈতিক দায়িত্ব ছিল। ইজরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা ভেরা মিচলিন-শাপির বলেছেন, "কেউ পুতিনের সঙ্গে কথা বলছেন না। ইজরায়েল এমন একটি খেলোয়াড় যে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারে।" কিন্তু সামনে কী হবে? উত্তরে মিচলিন সতর্ক করে দিয়েছেন যে ইজরায়েলের কাছে এমন একটি জটিল সঙ্কটকে সঠিকভাবে মধ্যস্থতা করার জন্য কূটনৈতিক হাতিয়ার নেই, সদিচ্ছা যাই হোক না কেন। ফ্রান্স (France) এবং তুরস্ক (Turkey) চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
ভাষ্যকার বারাক রাভিদ ইসরায়েলি ওয়ালা নিউজ সাইটে লিখেছেন, "একদিকে, (বেনেট) রাতারাতি তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থানকে উন্নত করেছেন এবং ইজরায়েলের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক পয়েন্ট জিতেছেন। অন্য দিকে, তিনি একটি বিশাল ঝুঁকি নিচ্ছেন, শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজের জন্যই নয় বরং ইজরায়েল রাষ্ট্র এবং বিশ্বে তার অবস্থানের জন্য। প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেনের কাদামাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে না জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি জানেন না যে এটি কতটা গভীর।" ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইজরায়েলের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন বলেছেন, "বেনেটের পদক্ষেপ সাহসী, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণও। পুতিনের মানসিক অবস্থার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। রাশিয়া আজ একটি ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে এবং পুতিন সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে পারেন। নাফতালি বেনেট তিনি কেবল মই সরবরাহ করতে পারেন।"
এখন পরিস্থিতি কী?
শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে ইতিমধ্যে তুরস্কে হাজির হয়েছেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। তুরস্কের আন্টালিয়া শহরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার তুরস্কের বিদেশমন্ত্রী মেভলুত চাভুসওগ্লু (Mevlut Casvusoglu) ও ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা (Dmitry Kuleba)-র সঙ্গে আলোচনার পর রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ (Sergey Lavrov) বলেছেন, "রাশিয়া যুদ্ধ চায় না। বর্তমান সঙ্কট শেষ করতে চায় রাশিয়া।" পরিস্থিতি সেইরকম হলে ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং ভ্লাদিমির পুতিন মুখোমুখি আলোচনায় বসতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন লাভরভ। তিনি বলেন, ভ্লাদিমির পুতিন জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত।
আরও পড়ুন: ২০২৪-এর মধ্যে বিরাট লক্ষ্য সরকারের! ঘোষণা রাজ্য বাজেটে, বহু মানুষ হবেন উপকৃত
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুক্রবার ১৬তম দিনে পড়েছে। প্রাণ বাঁচাতে একাধিক পড়শি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন বহু নাগরিক। যুদ্ধের কারণে কুড়ি লাখেরও বেশি মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। ঘুরপথে ইউক্রেনকে সাহায্য করেছে আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক দেশ। রাশিয়াকে আর্থিকভাবে ধাক্কা দিতে একের পর এক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে। রাশিয়া (Russia) থেকে কয়লা (Coal), তেল (Oil) ও গ্যাস (Gas) আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Ban) জারি করেছে আমেরিকা (United States)। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আমেরিকার কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল, নির্দিষ্ট পেট্রোলিয়াম পণ্য, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা নতুন করে কিনতে পারবে না। এছাডা়ও আমেরিকান কোনও সংস্থা রাশিয়ায় পাওয়ার সেক্টরে (Power Sector) বিনিয়োগ করতে পারবে না। গতকাল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন রাশিয়া ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র (Chemical Weapons) ব্যবহার করতে পারে। যদিও প্রথমে রাশিয়ার তরফেই সম্প্রতি বলা হয়েছিল যে ইউক্রেন রাসায়নিক হামলার পরিকল্পনা করছে। যদিও জেলেনস্কি জানান যে ইউক্রেন কোনও জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র বা অন্য ধরনের কোনও বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেনি।
ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় জেলনস্কি বলেন, "আমি একটা উপযুক্ত দেশের প্রেসিডেন্ট। সেই সঙ্গে দুই সন্তানের বাবা। আমার দেশে মানব সম্পদের চরম ক্ষতিকারক কোনও রাসায়নিক অস্ত্র বা বায়োলজিক্যাল অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হয় না। রাশিয়া যে এই ধরনের কাজ করে, তা গোটা বিশ্ব জানে। রাশিয়া যদি আমাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে তাহলে ফল মারাত্মক হবে।"
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Israel, Russia Ukraine War