#নয়াদিল্লি: দীর্ঘ আলোচনা কিংবা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কোনও কিছুতেই আমল না দিয়ে ইউক্রেনের প্রতি তাদের আগ্রাসন জারি রেখেছে রাশিয়া। সাড়া পৃথিবীর বাকি শক্তিধর দেশকে থোড়াই কেয়ার। ফলস্বরূপ নিজেদের অবস্থানেই অনড় রাশিয়া (Russia)। সাম্প্রতিক ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের প্রায় তিন সপ্তাহ হতে চলল। তবুও পিছু হটার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ক্রমাগত সেনা অভিযান, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মুহুর্মুহু রাশিয়ান বোমা বর্ষণ। কিন্তু রাশিয়ান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে নিজের দেশের মাটিকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর গোটা ইউক্রেনবাসী। তাদের সংকল্প একটাই- যে ভাবেই হোক দেশকে রক্ষা করতে হবে রাশিয়ার আক্রমণের হাত থেকে।
হিউম্যান করিডর কি সুরক্ষা দিতে পারবে?
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাশিয়ার আক্রমণে বিধ্বস্ত গোটা ইউক্রেন (Ukraine)। ক্রমাগত রাশিয়ান সেনাবাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা মিলছে না ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের। তাই রাশিয়ার আক্রমণ থেক নিজেদের প্রাণ রক্ষায় ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সে দেশের সেলিব্রেটিরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে অন্য দেশে ঠাঁই নিয়েছেন। তবে ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের নাগরিক এবং এবং সে দেশে থাকা অন্য দেশের মানুষের জন্য মানব করিডর (Human Corridor) অর্থাৎ সেফ জোন ফর হিউম্যানিটারিয়ান (Safe Zone For HUmanitarian) এলাকার কথা ঘোষণা করেছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানে গিয়েও যে সাধারণ নাগরিকদের প্রাণ বাঁচবে কিংবা রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ছোঁড়া বিধ্বংসী বোমা যে তাদের লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করা হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যেই ঘোর সংশয় তৈরি হয়েছে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এই সংশয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ বছর ছয়েক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানোর লক্ষ্যে রাশিয়া তৎকালীন বাসার আল আসাদ (Basar Al Asad) সরকারের পক্ষ নিয়ে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারী বিরোধীদের খতম করতে সামরিক অভিযান চালায়। ওই সময় সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকদের জন্য সিরিয়ার (Syria) রাজধানী দামস্কাসের (Damuskas) পার্শ্ববর্তী ইদলিব (Idleeb) শহরকে সেফ জোন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ওই সেফ জোনের নামে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে অবরুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান সেনা বাহিনী হামলা চালায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকা সাধারণ নাগরিকদের ওপর। অবশ্য এই হামলার ঘটনা নিয়ে আজও বিতর্ক এবং ঘটনার প্রকৃত সত্য অন্বেষণের শেষ নেই। কারণ ওই ঘটনার দায় আজও স্বীকার করেনি রাশিয়া। উল্টে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইদলিব শহরে আটকে থাকা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলার দায় চাপিয়ে দেয় সে দেশের বাসার আল সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের ঘাড়ে।
অতীতে কী হয়েছিল?
তবে হাজার বিতর্কের মাঝেই বছর ছয়েক আগের সেই ভয়াবহ দগদগে স্মৃতি আঁকড়ে আজও বেঁচে রয়েছেন এক ব্যক্তি। তিনি আর কেউ নন, সিরিয়ার একজন সাধারণ নাগরিক আফরা হাশেম (Afra Hashem)। বর্তমানে বছর চল্লিশের ওই ব্যক্তি লন্ডনে থাকেন। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি উস্কে হাশেম বলেছেন, ওই সময় অর্থাৎ বছর ছয়েক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সিরিয়ায় শান্তি ফেরাতে এবং তৎকালীন বাসার আল আসাদের সরকারকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে রাশিয়ান সেনাবাহিনী হামলা চালায় বিরোধীদের ওপর। এতে গোটা সিরিয়ায় যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হয়।
রাশিয়ান সেনার মূল লক্ষ্যই ছিল সরাকার বিরোধী চক্রান্তকারীদের যে কোনও মূল্যে নিকেশ করতে হবে। সরকার বিরোধী তকমা দেওয়া ষড়যন্ত্রকারীরাও অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে হামলা চালাতে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু এই যুদ্ধে প্রাণ যেতে পারে সিরিয়ার সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকদের। সেই কারণে রাজধানী দামাস্কাসের পাশে হামস এবং হামা শহরে সেফ জোন হিসাবে ঘোষণা করে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। অর পাশেই রয়েছে আলেপ্পো শহর। এ বিষয়ে হাশেম বলেন, সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে রাশিয়ান সেনাবাহিনী দেশের সাধারণ নিরস্ত্র জনগণকে ওই সেফ জোনে ঢুকে পড়ার নির্দেশ দেয়।
সেফ জোনেও চলেছিল গুলি
কিন্তু তাতেও রক্ষা মেলেনি সিরিয়ান সাধারণ নাগরিক ওই সেফ করিডর বা সেফ জোন ফর হিউম্যানিটরিয়ানে থাকাকালীন ওই জায়গায় ক্রমাগত হামলা চালায় রাশিয়ান সেনাবাহিনী। তাদের মুহুর্মুহু গুলি এবং বোমা বর্ষণে ওই এলাকা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপের রূপ নেয়। ফলে অগত্যা নিরুপায় হয়ে প্রাণ যায় বহু সিরিয়ান নাগরিকের। তিনি জানান ওই সময় প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের নিরাপদ সুনিশ্চিত করতে প্রায় ৩০ লক্ষ সিরিয়ান নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক আশ্রয় নিয়েছিল ওই মানব করিডর অর্থাৎ সেফ জোনে।
রাশিয়ার সাফাই
পাল্টা ওই ঘটনার দায় ঝেড়ে রাশিয়ান সেনাবাহিনী দাবি করে ওই মানব করিডর অর্থাৎ সেফ জোনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঢুকে যায় ষড়যন্ত্রকারী দস্যুরা। শুধু প্রবেশ করাই নয় সেফ জোনের সুযোগ নিয়ে ওই জায়গা থেকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালতে থাকে সরকার বিরোধীরা।
ওই ঘটনায় ইতি টেনে সাম্প্রতিক রাশিয়া- ইউক্রেন সংঘর্ষের মাঝে ফের একবার কিছু অঞ্চলকে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের জন্য মানব করিডর বা সেফ জোন ঘোষণা করেছে রাশিয়া সরকার। যেখানে নিরাপদ এবং নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ইউক্রেনের নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকরা। আর এই ঘোষণার পরই নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
এবার জেনে নেওয়া যাক মানব করিডর বা সেফ জোন ফর হিউম্যানিটরিয়ান আসলে কী?
এ বিষয়ে রাষ্ট্র সঙ্ঘের (United Nations) তথ্য অনুযায়ী মানব করিডর বা সেফ জোন ফর হিয়ম্যানিটরিয়ান হল এমন একটি করিডর বা জায়গা যেখানে যুদ্ধ চলাকালীন নিরাপদে থাকতে পারেন দেশের সাধারণ নিরস্ত্র নাগরিকরা। যে সকল দেশের মধ্যে এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়ে তাদের পক্ষ থেকেই শত্রুপক্ষের দেশের সাধারণ নাগরিকদের প্রাণ রক্ষায় সহায়তা করতে উভয় দেশ শত্রুপক্ষের দেশের এক বা একাধিক এলাকাকে সেফ জোন ফর হিউম্যানিটরিয়ান বা মানব করিডর হিসাবে ঘোষণা করতে পারে। শুধুমাত্র ঘোষণা নয়। শত্রুপক্ষের দেশের সাধারণ নাগরিককে ওই সেফ জোন অর্থাৎ মানব করিডরে আশ্রয় নেওয়ার আর্জিও জানানো হয় উভয় দেশের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন- রাশিয়ান তেলের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা! এর কী প্রভাব পড়তে পারে গোটা বিশ্বে
ইউক্রেনে কি সেফ জোন তৈরি হয়েছে?
ইতিমধ্যেই রাশিয়ান সেনাবাহিনীর মুহুর্মুহু গুলি ও বোমাবর্ষণের হাত থেকে ইউক্রেনের নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখার কথা বলে রাশিয়ার সীমান্ত লাগোয়া ইউক্রেনের একাধিক জায়গা সেফ জোন বা মানব করিডর হিসাবে চিহ্নিত করেছে রাশিয়া সরকার। সেখানে আশ্রয় নেওয়া ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের ওপর কোনও রকম আক্রমণ চালাোন হবে না বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে রাশিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে।
সেফ জোনের ব্যর্থতা
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৯০ বসনিয়া (Bosnia) আক্রমণ ও যুদ্ধের প্রাক্কালে সাধারণ নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার উদ্দেশ্যে সালে প্রথম জাতি সঙ্ঘের আলোচনায় উঠে আসে সেফ জোন ফর হিউম্যানিটরিয়ান বা মানব করিডরের প্রসঙ্গও। কিন্তু শত চেষ্টার পরেও ওই যুদ্ধে বসনিয়ার সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি জাতি সঙ্ঘের মানব করিডর। কারণ মানব করিডরকে উপেক্ষা করে সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলা চালায় শত্রু পক্ষের সেনাবাহিনী।
মানব করিডর কি পরবর্তীতে সিরিয়ার যুদ্ধে কাজ করেছিল ?
এক কথায় এর উত্তর হবে না। কারণ মানব করিডর ঘোষণার পরও রাশিয়ান সেনা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা মেলেনি হাজার হাজার সাধারণ সিরিয়াবাসীর। কারণ ওই সময় সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তৎকালীন বাসার আল আসাদের সরকারের সমর্থনে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যর্থ করতে সিরিয়ায় গুরুতর সংঘর্ষে লিপ্ত হয় রাশিয়ান সেনাবাহিনী। ওই সময় পরিস্থিতি এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে তাদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা মেলেনি সাধারণ সিরিয়ান নাগরিকদের।
আরও পড়ুন- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কী কী অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে? বিশদে জানুন
এ বিষয়ে বিতর্কের মাঝেই বিশ্ব মানবাধিকার (Human Rights) সংগঠনের এক সদস্যা জানিয়েছেন, ওই সময় রাশিয়ার তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় মাত্র দু'দিনের জন্য সিরিয়ার রাজধানী দামস্কাসের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে সেফ জোন বা মানব করিডর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে ওই এলাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে অবরুদ্ধ করে হামলা চালানো হয়। এতে কয়েক লক্ষ নিরস্ত্র মানুষের প্রাণ যায় নিরুপায় হয়ে। এমনকী হামলা চালানোর পূর্ব মুহূর্তে ওই স্থানটিকে সেফ জোন বা মানব করিডরের সংজ্ঞা থেকে সরিয়ে নেয় রাশিয়া।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Russia Ukraine War