সরকার কেন মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়াতে চাইছে?
গত বছরের অগাস্টে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) মহিলাদের ক্ষমতায়নের (Women’s Empowerment) জন্য সওয়াল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "যখনই মহিলাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ভারতকে গর্বিত করেছে এবং দেশকে শক্তিশালী করেছে। এখন আমাদের দৃঢ় সংকল্প হচ্ছে মহিলাদের সমানতা প্রদান করা। তাদের জন্য স্ব-কর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া।" সরকার যে মহিলাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে ক্রমাগত উদ্বিগ্ন, তাও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মেয়েদের অপুষ্টি (Malnutrition) থেকে বাঁচাতে তাদের সঠিক বয়সে বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সরকার মহিলাদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে এবং রিপোর্ট জমা পড়ার পরে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
advertisement
আরও পড়ুন: Omicron-র Symptoms? কত দিন অপেক্ষা করে পরীক্ষা করাবেন?
সমতা পার্টির প্রাক্তন প্রধান জয়া জেটলির (Jaya Jaitly) নেতৃত্বে গঠন হওয়া কমিটির সংক্ষিপ্ত বিবরণে যে বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে সেগুলি হল- বিয়ের বয়সের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং গর্ভাবস্থা, জন্ম, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সুস্থতা, পুষ্টি, মাতৃত্ব, শিশুমৃত্যুর হার (Infant Mortality Rate), মাতৃমৃত্যুর হার (Maternal Mortality Rate), সন্তানধারণের হার (Total Fertility Rate)। মহিলাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে কমিটির রিপোর্টে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে যে কমিটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিকোণ থেকে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি প্রশ্নটিকে বিবেচনা করেনি। গত বছর কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন (Nirmala Sitharaman) বলেছিলেন যে ভারত আরও এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের জন্য উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মজীবন অর্জনের সুযোগ উন্মুক্ত হবে। তিনি বলেছিলেন, "মাতৃমৃত্যু কমানোর পাশাপাশি পুষ্টির উন্নতি করা অপরিহার্য। একটি মেয়ের মাতৃত্বে প্রবেশ করার বয়স সম্পর্কে পুরো বিষয়টিকে এই আলোকে দেখা দরকার।"
আরও পড়ুন:করোনার অন্য প্রজাতির তুলনায় ওমিক্রনের উপসর্গগুলি কি তাড়াতাড়ি দেখা যায়?
কমিটি কী সুপারিশ করেছিল?
কেন্দ্রীয় সরকারের গড়া কমিটিতে স্বাস্থ্য, আইন এবং মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের আধিকারিকরাও ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে প্রথম গর্ভাবস্থার সময় একজন মহিলার বয়স কমপক্ষে ২১ বছর হতে হবে। জয়া জেটলি বলেছেন, এই সুপারিশ বা পরামর্শগুলির পিছনের কারণটি কখনই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছিল মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়। কমিটি জোর দিয়ে বলেছে যে শিক্ষা এবং জীবিকার ক্ষেত্রে মহিলাদের আরও প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। এর জন্য় আইন কার্যকর হওয়ার দরকার। সাম্প্রতিক তথ্য থেকে এটা জানা যাচ্ছে যে ভারতে সন্তানধারণের হার ইতিমধ্যেই হ্রাস পাচ্ছে। ভারত আর বিস্ফোরক জনসংখ্যা বৃদ্ধির মুখোমুখি হচ্ছে না।"
বিশ্ব ব্যাঙ্কের (World Bank) মতে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ৫ মহিলার মধ্যে মাত্র ১ জন শ্রমশক্তির (Labour Force) অংশ। যা বিশ্বব্যাপী গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৫ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য ভারতে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ৭৫ শতাংশ।
বর্ধিত ন্যূনতম বিয়র বয়স কী ভাবে বাস্তবায়িত হবে?
কেন্দ্রীয় সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়াতে সংসদে বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা (সংশোধনী) বিল (The Prohibition of Child Marriage Amendment Bill-2021) লোকসভায় পেশ করেছিল। যদিও, সেই বিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। লোকসভায় বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি (Smriti Irani)। তিনি যুক্তি দেন, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য এই আইন আনা জরুরি। এর পরেই বিরোধীরা গর্জে ওঠে। তাদের বক্তব্য, বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই বিলটি আনা হয়েছে। তাছাড়া এই বিলের খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। তাদের দাবি মেনেই বিলটিকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইন রয়েছে। যেগুলি আইন সংশোধনীর ফলে প্রভাবিত হবে। যদিও হিন্দু বিবাহ আইনে বলা হয়েছে যে বিয়ের সময় পুরুষের বয়স ২১ এবং মহিলার বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হওয়া উচিত। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বলা হয়েছে যে বয়ঃসন্ধি প্রাপ্ত নাবালকের বিয়ে অনুমোদিত।
বিল নিয়ে কী কী প্রশ্ন উঠছে?
মহিলা অধিকার এবং সামাজিক অধিকার কর্মীদের মধ্যে এই বিল নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকেই মহিলাদের বিয়ের বয়স আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের বক্তব্য, মহিলাদের উন্নয়নে আনা বিদ্যমান অনেক আইন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তারা উল্লেখ করেছে যে মহিলাদের কর্মসংস্থান, উপার্জন এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে মহিলাদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া না হয়।
অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া (Oxfam India) নামে একটি সংগঠন যুক্তি দিয়েছে যে মহিলাদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত সমাজের একটি বড় সংখ্যক মহিলাকে অপরাধী করে তুলবে, যারা তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছে। আদতে শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং দরিদ্র পরিবারের জন্য আয় বৃদ্ধি, চাকরির বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত। এছাড়াও মহিলাদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে আরও অনেক কিছুই করা যেতে পারে।
এটা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভারতে বাল্যবিবাহের ঘটনা কমছে। ২০০৫-২০০৬ সালে ভারতে ১৮ বছরের নিচে ৪৭ শতাংশ মহিলা বিয়ে করেছে। যেখানে সর্বশেষ তথ্য বলছে যে ২০১৯-২০২০ সালে এই হার নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে। তবুও এটি অনেক বেশিই। ভারতে এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যয় অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলা বিয়ে করে। এর পিছনে কারণ হল বিদ্যমান আইন সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়া। অক্সফাম ইন্ডিয়া বলছে, ২০১৮ সালে সারা ভারতে মাত্র ৫০১টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
তবে শিক্ষা, দক্ষতা, স্বাস্থ্যসেবা এবং চাকরিতে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির মতো আইনের কারণেই শুধুমাত্র নির্ধারিত বয়সে বিয়ে করার হার মহিলাদের মধ্যে বাড়েনি। মেয়েরা যখন আরও পড়াশোনা করতে পারে এবং অর্থ উপার্জন করতে পারে, তখন তাদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়। তাদের মধ্যে বিনিয়োগ করার ও দেরিতে বিয়ে করার ইচ্ছা জাগে। একই ভাবে, যখন অল্পবয়সী মায়েদের খারাপ স্বাস্থ্যের কথা আসে, তখন দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রক্তাল্পতা এবং স্বাস্থ্য অবহেলা বেশি অবদান রাখে।
মহিলা অধিকার সংগঠনগুলির দ্বারা চিহ্নিত আরেকটি সমস্যা হল বিয়ের বয়স বৃদ্ধি হলে মহিলাদের জীবন এবং ব্যক্তিগত পছন্দের উপর প্রভাব পড়বে। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া বলেছে যে এটি দেখা গিয়েছে যে মেয়ের পছন্দ অনুযায়ী বিয়েতে বাধা দেওয়ার জন্য় বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইনের অপব্যবহার করা হয়। অনেক সময় পছন্দের সঙ্গীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে মেয়ের বাবা-মা বা আত্মীয়রা এই আইনে মামলা দায়ের করে। এই ধরনের মামলাগুলি বলপূর্বক বিয়ে চাপিয়ে দেয়।