শ্রীলঙ্কার মাটিতে জরুরি অবস্থার ইতিহাস :
সাম্প্রতিক প্রবল অর্থসংকটের কোপে পড়ে ভয়াবহ অবস্থা দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার। এই অবস্থায় গোটা দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি মাসের ১ এপ্রিল থেকে শ্রীলঙ্কার মাটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন সে দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষ। কিন্তু ইতিহাস বলছে শ্রীলঙ্কার মাটিতে এই প্রথম নয়, এর আগেও বার কয়েক সে দেশের মানুষকে জরুরি অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদরা বলেছেন, স্বাধীনতার পর শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সে বার ভাষা আন্দোলনের মাত্রা গোটা দেশ জুড়ে তীব্র আকার ধারণ করে। ওই সময় গোটা শ্রীলঙ্কার উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই সময় গোটা শ্রীলঙ্কায় শুধুমাত্র সিংহলি ভাষা চালু করতে চেয়েছিল সে দেশের সরকার। ওই সময় ভাষা নিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারের এই একপেশে নীতির বিরুদ্ধে পথে নেমে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন সে দেশের হাজার হাজার জনতা। ওই সময় গোটা দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল।
advertisement
তবে ওই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর সরকারের লাগাতার জরুরি অবস্থা জারির বিরুদ্ধে ফের পথে নেমে বিদ্রোহ শুরু করেছিল বামপন্থী জনতা বিমুক্তি পেরামুনা। মাত্র চার বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মৈত্রীপাল সিরিসেনা দেশের কিছু অংশে মুসলিম বিরোধী প্রদেশে হিংস্র আন্দোলনকে প্রতিহত করতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। ওই সময় গোটা দেশে মৃত্যু, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তিহানির মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছিল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ঘটনার আগে ২৭ বছর ধরে লাগাতার অবিরাম জরুরি অবস্থার অধীনে ছিল দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১১ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত এই সাতাশ বছর জরুরি অবস্থা জারি ছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতে। গোটা দেশ ব্যাপী তামিলবিরোধী দাঙ্গা সামাল দিতেই গোটা দেশে সরকারি অঘোষিত জরুরি অবস্থার শিকার হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের।
আরও পড়ুন : চকচকে আপেলেই লুকিয়ে থাকে মারণরোগ, জানেন কি?
এমনকী মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দুবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষ। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ৩০ অগাস্ট সে দেশে প্রথম জরুরি অবস্থা জারি করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। কারণ গত বছরের শুরু থেকেই প্রবল অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কাঠামো। ওই বছর দেশের সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে প্রতিহত করতে মাত্র এক বছর আগে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়য় রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে। তবে ওই সময় উদ্ভূত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরেই মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জরুরি অবস্থা ফিরিয়ে নেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষ।
জরুরি অবস্থা কীভাবে ঘোষণা করা হয় বা এর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কী?
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সংবিধানের ১৫৫ ধারায় দেশের রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় আইনে ১৯৪৭ সালের পাবলিক সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স (PSO) জারি করে তার মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার কাঠামো প্রদান করা হয়েছে। দেশের জনগণের নিরাপত্তা, সম্পত্তি সংরক্ষণ, দেশের শৃঙ্খলারক্ষা, এছাড়াও দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা সরবরাহ ও পরিষেবা রক্ষার স্বার্থে সমীচীন বা প্রয়োজন বোধ করলে দেশের রাষ্ট্রপতি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। দেশের রাষ্ট্রপতি দ্বারা ঘোষিত জরুরি অবস্থা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে অনুসন্ধান, গ্রেফতার এবং আটক করার বিশেষ ক্ষমতা দেয়। এ বিষয়ে উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বিগত ২০০৫ সালে তৎকালীন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদিরগামারের হত্যার পর গোটা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ওই সময় গোটা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসের বাতাবরণ রুখতে সে দেশের সংসদীয় আইনে নতুন করে একাধিক ধারা তৈরি ও পরিবর্তন (EMPPR) করে তা কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। এর ফলে সন্ত্রাসবাদীদের বাড়বাড়ন্ত হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছুটা সন্ত্রাসমুক্ত হয় গোটা শ্রীলঙ্কা। এছাড়াও সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ওই দেশে রয়েছে ১৯৭৯ সালের কঠোর সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধী আইন। তবে ওই আইনতই অতি কঠোর হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠনের সমালোচনার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের কঠোর আইনকে শিথিল করতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা সরকার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমালোচনার জবাবে শ্রীলঙ্কা সরকার সম্প্রতি এই আইনটি সংশোধন করেছে। কিন্তু দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সমালোচকদের সন্তুষ্ট করার জন্য এটি যথেষ্ট নয় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন : যৌনক্ষুধা বাড়িয়ে জীবনকে রোমাঞ্চে ভরিয়ে তুলতে এই মশলাগুলি জুড়িহীন
জরুরি অবস্থায় সংসদের ভূমিকা কী?
গোটা দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও এর মেয়াদ কিন্তু মাত্র এক মাস। পাশাপাশি এই জরুরি অবস্থা যদি দীর্ঘমেয়াদী করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রপতিকে দেশের সংসদের কাছে প্রত্যেক ১৪ দিন অন্তর বর্তমান পরিস্থিতি উল্লেখ করে নতুন করে অনুমোদন চাইতে হবে। জরুরি প্রবিধানগুলি এক মাসের জন্য বৈধ, তবে রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই প্রতি ১৪ দিনে এক মাসের বেশি ঘোষণা বা জরুরি অবস্থা বাড়ানোর জন্য অনুমোদন চাইতে হবে। রাষ্ট্রপতি যদি তা না করেন তা হলে জরুরি অবস্থার আর কোনও গুরুত্ব থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও সংসদীয় আইনের পাবলিক সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্সের (PSO) মাধ্যমে এই জরুরি অবস্থা বাতিলের আইনও রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জাতিসংঘের শ্রীলঙ্কার বিশেষ প্রতিবেদক রাধিকা কুমারস্বামী উল্লেখ করেছেন যে, যদিও ১৯৭৮ সালের সংবিধান একটি ঘোষণার বৈধতা নিয়ে সংসদীয় বিতর্ককে সীমাবদ্ধ করেছে এবং এটি প্রকৃত জরুরি অবস্থা চালু করার সমস্ত আইন নিয়ে বিতর্ক করতে সক্ষম করে না, তথাপি পাবলিক সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্সের এমন একটি আইন রয়েছে যার অধীনে সংসদ তা বাতিল করতে পারে। একটি রেজোলিউশনের বা সংসদীয় নিয়মের মাধ্যমে একটি ওই আইনটি সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে গত ২০০৪ সালে সাংবিধানিক আইনের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী শ্রীলংকার সংসদে ওই আইনটির কোনও বদল হয়েছে এমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : ঝোড়ো যৌনজীবনেও অধরা অর্গ্যাজম? মহিলারাও পেতে পারেন শীর্ষ রতিসুখ
জরুরি অবস্থায় কী কী ছাড় দেওয়া হয়?
এ বিষয়ে কলম্বো থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস (Colombo Think Tank for Policy Alternatives)-এর তথ্য অনুযায়ী জরুরি অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, নির্যাতনের নিষেধাজ্ঞা এবং একটি উপযুক্ত আদালতের দ্বারা একটি ন্যায্য বিচারে শুনানির অধিকারকে এই জরুরি অবস্থা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ-প্রশাসন দ্বারা গ্রেফতারের জন্য সাধারণ পদ্ধতি এবং আটকের পর বিচারের প্রক্রিয়া, এছাড়াও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার যেমন, মতপ্রকাশ, সমাবেশ, সমিতি, পেশা, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষার স্বাধীনতার মৌলিক অধিকাররের মতো বিষয়গুলিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কলম্বো থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস-এর তথ্য অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার সংবিধানে এই অধিকারগুলিকে সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। তাই জরুরি অবস্থা জারি হলেও এই বিষয়গুলি সাধারণত ও দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করার জন্য নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছা এবং আইনের শাসন তথা মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্য আদালতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।