মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই তাঁকে অভিনয়ের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন মৃণাল৷ শৈশবে পিতৃহীন কিশোরী শ্রীলার মায়ের দ্বিধার উত্তরে বরেণ্য পরিচালক জানিয়েছিলেন, মাধ্যমিকের পরেই শুরু হবে শ্যুটিং৷ সেই শুরু ১৯৮০ সালে৷ বেতার নাটকে, শ্রুতি বিজ্ঞাপনে পরিচিত শ্রীলা ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবির মিনু হয়ে পর্দায় আত্মপ্রকাশ করলেন৷ ‘পরশুরাম’ আগে মুক্তি পেলেও শ্রীলা প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’-এ৷ পরিচালকের একাধিক ছবিতে কাজ করতে করতেই অভিনয়ের অ-আ-ক-খ আত্মস্থ করেছেন তিনি৷ সেই শেখার যাত্রাপথ তাঁর বজায় ছিল আজীবন৷ জীবনের পড়ন্ত বেলাতেও চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে উজাড় করে দিতেন সবটুকু৷ সমসাময়িক আলো থেকে কিছুটা দূরে থাকতেন ইদানীং৷ কর্কটরোগের সঙ্গে যুদ্ধ শেষবেলায় খারিজ করে চলে গেলেন শ্রীলা৷
advertisement
আরও পড়ুন : আশৈশব বৃক্ষরোপণই নেশা! অযোধ্যা পাহাড়তলির প্রত্যন্ত গ্রামের গাছদাদু দুখু মাঝির শ্রীহীন ঘরে এল পদ্ম পুরস্কার
শৈশব কৈশোরে অভিনয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, সেই বন্ধন ছিল অবিচ্ছেদ্য৷ মাধ্যমিকের পর ওয়ার্কশপ করতে যেতেন মৃণালঘরনি গীতার কাছে৷ তিনি যা হয়েছেন জীবনে, তার জন্য বার বার কুর্নিশ জানিয়েছেন সেন দম্পতিকে৷ তাঁর মতো খাঁটি হিরে কী করে ধরা পড়ল মৃণাল সেনের জহুরির চোখে? এক সাক্ষাৎকারে শ্রীলা জানিয়েছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবির জন্য পরিচালক খুঁজছিলেন ছিপছিপে রোগা, কৃষ্ণাঙ্গী এমন এক তরুণীকে, যাঁর চোখজোড়া খুব উজ্জ্বল৷
‘আকাশবাণী’-তে ‘আত্মজা’ বেতার নাটকে শ্রীলার কণ্ঠাভিনয় শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনুপকমার৷ তাঁর সূত্রে খবর পেয়েছিলেন মৃণাল৷ এর পর শ্রীলার অজান্তেই নাটকের মহড়ায় হাজির হন মৃণাল৷ কথা বলেন শ্রীলার সঙ্গে৷ কিশোরীর সারল্য ও সপ্রতিভতা তাঁকে মুগ্ধ করে৷ এর পরই কার্যত মৃণাল সেনের পারিবারিক এবং ছবির ইউনিটের অংশ হয়ে ওঠেন তিনি৷
মৃণাল সেন পরিচালিত ‘পরশুরাম’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘খণ্ডহর’ ছবিতে শ্রীলা একের পর এক নিজেকে ভাঙেন৷ আবার গড়েন৷ প্রতি ছবিতে নতুন রূপে ধরা দেন তিনি৷ শ্যম বেনেগালের ‘আরোহণ’, ‘মাণ্ডী’ বা উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’ ছবিতে কাজ তাঁর অভিনয়জীবনের মাইলফলক৷ আবার এই শ্রীলাই দর্শকের চোখে সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে ধরা দেন ‘প্রতিবাদ’, ‘রাঙা মাটি’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘মন ময়ূরী’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘পূজা’-র মতো বক্সঅফিস সফল বাণিজ্যিক ছবিতে৷
আরও পড়ুন : শৈশবে অপছন্দ গানবাজনা, অজান্তেই সুরলোকের বরপুত্র মিয়াঁ তানসেনের এই উত্তরসাধক
গত দু’ দশকে কাজ করা কমিয়ে দিয়েছিলেন৷ ‘শঙ্কর মুদি’, ‘দ্য পার্সেল’, ‘শ্লীলতাহানির পরে’-র মতো ছবিগুলিতে ফিরিয়ে এনেছিলেন কয়েক টুকরো স্বর্ণযুগের আবহ৷ শেষ ছবি মুক্তি পেয়েছিল গত বছর৷ কাজ করেছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পালান’-এ৷ যে মৃণাল সেনের অভিনয়জীবন শুরু করেছিলেন, ইতিও পড়ল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যেই৷
আরও পড়ুন : প্রেমে বাধা হয়নি বেড়াজাল, রাশিদের ছন্দের দোসর স্ত্রী জয়িতাই, তাঁদের আনন্দ মুহূর্ত এখন স্মৃতির জলছবি
কৃত্রিমতা থেকে দূরে সহজ জীবন কাটাতে ভালবাসতেন৷ সব সময় বিশ্বাস করতেন যা যোগ্যতা, তার থেকে পেয়েছেন অনেক বেশি৷ আক্ষেপ ছিল, কথা হয়েও ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে অভিনয় করা হয়নি৷ ‘হীরের আংটি’-র পরে একটি ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল শ্রীলার৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি বাস্তবায়িত হয়নি৷ ‘চোখের বালি’-তে ঐশ্বর্য রাইয়ের কণ্ঠে ডাবিং নিয়েও প্রকাশ্যে কোনওদিন কিছু বলতে চাননি৷
বিতর্ক, বিবাদ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আড্ডায় গল্পে, কবিতা পড়ে, ছোটগল্প লিখে জীবন কাটাতে ভালবাসতেন৷ সেই জীবন রয়ে গেল সেলুলয়েডে এক মহাজীবন হয়ে৷ বাংলা ছবির ‘শাবানা আজমি’ বা ‘স্মিতা পাতিল’ পরিচয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থেকে।