#কলকাতা: তনু জেঠু সম্পর্কে যাই লিখি না কেন, তা-ই আমার ধৃষ্টতা পরিচয়। অত জ্ঞান আমার নেই যে তরুণ মজুমদারকে নিয়ে লিখব। তবে হ্যাঁ কিছু স্মৃতি তো রয়েই যাবে চিরকাল। সেগুলি নিয়েই কলম ধরতে পারি। এই মানুষটার অবদান আজ বাংলা ছবিকে নিয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে৷ আমরা যারা এখন কাজ করছি বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে, তারা নিজেদের ধন্য বলে মনে করি, কারণ ইন্ডাস্ট্রির এক জন বাহক হলেন তরুণ মজুমদার। ওঁর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু আক্ষেপ একটাই, হয়তো সেই সংখ্যাটা বেশি হতে পারত। হল না, তার মূল কারণ বার্ষিক পরীক্ষা।
advertisement
ছোটবেলায় তনু জেঠু আমাকে চার বার ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওঁর ছবিতে কাজ করার জন্য। কিন্তু যেই সময়ে শ্যুটিংটা হত, তখন আমার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলত। তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে অভিনয় করা হয়নি তখন।
তবে চার নম্বর ছবির জন্য যখন ডেকেছিলেন, তখন অন্য একটি কারণে আমি কজা করতে পারিনি। সে বারও আর একটি কাজের সঙ্গে তারিখ মিলে যায়। তা হল সত্যজিৎ রায়ের 'শাখা প্রশাখা'। আমার বাবা-মা খুব দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। এক দিকে সত্যজিৎ রায়, অন্য দিকে তরুণ মজুমদার। কিন্তু এখানেই এক জন শিল্পীর মাহাত্ম্যের পরিচয় পেয়েছিলাম। তনু জেঠু বাবা-মাকে ডেকে বলেন, "মানিকদার ছবিতেই কাজ করুক সোহম।" এক শিল্পীর আর এক শিল্পীর প্রতি সম্মানের উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
বড় হওয়ার পর সেই মানুষটার সঙ্গে আবার কাজের সুযোগ পাই। আসলে আমি এমন বয়স থেকে এমন এমন স্তরের প্রতিভার সঙ্গে কাজ করেছি যে, তাঁদের মহিমা বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়নি তখনও। কিন্তু 'চাঁদের বাড়ি'তে তনু জেঠুর সঙ্গে যখন কাজ করেছি, তখন আমি পরিণত। আমি তখন আর শিশুশিল্পী নই। তাই ওঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা যে কী, তা বোধগম্য হয়েছিল।
খুব ভয় লাগত, দুশ্চিন্তা হত। বারবার মনে হত, পারব তো? আমার দ্বারা হবে তো? কিন্তু তনু জেঠু যে ভাবে বিনম্র হয়ে চরিত্র, দৃশ্য বোঝাতেন, ভয় যেত উধাও হয়ে। এখন ভাবি, অত উঁচুতে থেকে মানুষটার অত বিনম্রতা, বিনয় কোথা থেকে আসত? হয়তো এত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি বিনয়ী। আমি ধন্য। এক জন অভিনেতার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। সেতার বাজবে, শুধু অভিব্যক্তি থাকবে আমার এবং কোয়েলের। জেঠু ক্যামেরার পাশে বসে আমাদের দৃশ্যটি বোঝাচ্ছিলেন। ওই কথাগুলিই আমাদের ভিতর থেকে অভিব্যক্তি বার করে এনেছিল। এক জন অভিনেতা-অভিনেত্রীর থেকে অভিনয় সত্তা বার করে আনতে পারতেন তিনি।
আরও পড়ুন: ‘অপরাজিত’ দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন, অক্সফোর্ডে অনীকের মনে পড়ছে আইসিইউ-তে যোদ্ধা ‘চিরতরুণ’কে
সেই তরুণ মজুমদার আজ নেই। এই শূন্যস্থান পূরণ হবে না কোনও দিনও। উনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন। আমাদের আশীর্বাদ করুন যেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রি আরও এগিয়ে যেতে পারে। এই দিকপাল পরিচালকদের আশীর্বাদ বড়ই প্রয়োজন। তরুণ মজুমদার, তপন সিনহা, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, এঁরা থেকে যান।