নামের পাশে আরও বহু অপরাধ এবং জেল পালানোর দায় নিয়ে সজল একদিন উধাও হয়ে যান৷ ২০১৭ সালের পর আর খোঁজ মেলেনি তাঁর৷ প্রতিশোস্পৃহা মেটাতে গিয়ে দাগি অপরাধী হয়ে যাওয়া সজল বারুইয়ের ভূমিকায় আয়ুষ দাসের অভিনয় দর্শকদের মন কাড়বে৷ শমীক রায়চৌধুরীর পরিচালনায় এই পর্বের সংলাপও বেশ শাণিত৷ তবে পর্বের দৈর্ঘ্য আরও কিছুটা বেশি হলে সজল বারুইয়ের চরিত্রটি আরও বেশি ধরা দিত৷ প্রথম অপরাধ থেকে তার দাগি অপরাধী হয়ে ওঠার যাত্রাপথ দেখালে ছন্দপতন হত না এই পর্বের৷
advertisement
আরও পড়ুন : মগনলাল মেঘরাজের মুলুকে কেমন হল একেনবাবুর অভিযান? পড়ুন ‘The একেন-বেনারসে বিভীষিকা’-র রিভিউ
সজল বারুইয়ের ভূমিকায় আয়ুষ দাস
সজলের যেমন রক্তে হাতেখড়ি নিজের বাড়িতেই, কামরুজ্জামান সরকারের মনে অপরাধের বীজবপন করেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে নিয়মিত অবদমন৷ নিতান্ত ছাপোষা চেহারার এই যুবক ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কালনার গ্রামগুলিতে ছিলেন ত্রাস৷ নির্জন দুপুরে তিনি বেছে বেছে খুন করতেন মহিলাদের৷ বেশিরভাগ সময়ে আসতেন বিদ্যুতের মিটার পরীক্ষা করার নামে৷ তার পর ফাঁকা বাড়িতে সাইকেলের চেন দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করতেন মহিলাদের৷ হত্যালীলার ধরন দেখে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘চেনম্যান’৷ ঘাতকের হত্যার মাধ্যম একটাই-সাইকেলের চেন এবং তাঁর শিকারদের পরনে থাকত লালরঙের পোশাক৷ মৃত্যুতেই থামত না কামরুজ্জামানের রিরংসা৷ মৃতার দেহের সঙ্গে চলত বিকৃত সম্ভোগ৷ এরকম দুঁদে অপরাধীর কুকর্মের চালচিত্রকে সিরিজের একটি পর্বে রূপায়িত করার পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সাংবাদিক সপ্তর্ষি সোমের গবেষণা৷ যথাযথ রিসার্চ ছাড়া বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন অধরাই থেকে যায়৷ পাশাপাশি কুর্নিশ কামরুজ্জামান সরকারের ভূমিকায় দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয় এবং তাঁর চরিত্রোপযোগী বাচনভঙ্গিকে৷ অভিরূপ ঘোষের পরিচালনায় এই পর্ব ‘গণশত্রু’ সিরিজের শোস্টপার হতে পারে অনেক দর্শকের কাছে৷
আরও পড়ুন : অঙ্কস্যার আর পপিন্স পাশে থাকলে ঘোতনের মতো টাট্টুঘোড়াও উড়ে যেতে পারে পক্ষীরাজ হয়ে! মাক্কালী!
কামরুজ্জামান সরকারের ভূমিকায় দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
রক্তের গন্ধ পাগল করে দিত কামরুজ্জামানকে৷ নেশা ধরে যেত তাঁর৷ ঠিক যেমন ঘোর লাগত ত্রৈলোক্যতারিণীর৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি দু’ চোখে ঘোরমাখা স্বপ্ন নিয়ে এঁদো গ্রামের কূপমণ্ডুক জীবন থেকে মুক্তি পেতে কলকাতায় এসেছিলেন ত্রৈলোক্যতারিণী৷ সম্পন্ন গৃহিণীর পরিবর্তে তিনি হয়ে যান ব্রিটিশ কলকাতার ডাকসাইটে বারবনিতা৷ প্রেমিকের হাতবদল হয়ে যাওয়া ত্রৈলোক্যর চোখের জল যত শুকিয়েছে, তত গাঢ় হয়েছে ঠোঁটের দোক্তা৷ দেহ ব্যবসার মক্ষীরানি ত্রৈলোক্য একের পর এক খুন করেছেন৷ নির্দ্বিধায় লুঠপাট করেছেন নিহতদের মূল্যবান অলঙ্কার৷ অপরাধের জাল অনেক দূর বিস্তার করতে পেরেছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল খুনি ত্রৈলোক্যতারিণী৷ নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের দুঁদে বাঙালি গোয়েন্দা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে৷ তাঁর কালঘাম কতটা ছুটেছিল, সেটা নিজেই পরে ‘দারোগার দপ্তর’ বইয়ে লিখেছেন প্রিয়নাথ৷ তাঁর লেখা অবলম্বন করেই এই পর্ব৷ তাঁদের সেরা অভিনয় না হলেও নাম ভূমিকায় পাওলি দাম এবং প্রিয়নাথের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ যথাযথ ৷ তবে সেট, পোশাক, মেকআপের মতো এই পর্বের চরিত্রদের সংলাপ ও বাচনভঙ্গিও ঘটনার কালপর্বের সময়োপযোগী হওয়া দরকার ছিল৷ উনিশ শতকের চরিত্রদের সংলাপে কিন্তু মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে গিয়েছে একুশ শতকের শব্দ৷ ১৮৮৪ সালে ফাঁসি হওয়ার আগে ত্রৈলোক্য না চাইলে দারোগা প্রিয়নাথ তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারতেন না৷ সপ্তর্ষি সোমের গবেষণা এবং মধুরা পালিতের পরিচালনা এই পর্বকে সমৃদ্ধ করেছে৷
আরও পড়ুন : কর্পোরেট অফিস সুখের হয়…কেমন হল শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ছবি ‘আমার Boss’? পড়ুন রিভিউ
ত্রৈলোক্যতারিণীর ভূমিকায় পাওলি দাম
জন্মদাত্রী না হলেও হরির প্রতি অপত্যস্নেহ দুর্বল করেছিল ত্রৈলোক্যর মনকে৷ অপরাধের পাঁকের মাঝে সেখানে ফুটত অধরা মাতৃত্বের ফুল৷ এই স্নেহের ফাঁদেই ত্রৈলোক্য স্বীকার করেছিল অপরাধ৷ ত্রৈলোক্যর মতো রশিদ খানও চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে৷ তাই কন্যা রুকসানার জন্য এমন পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে কোনওদিন তাঁর আদরের মেয়েকে আতান্তরে পড়তে না হয়৷ অন্যের রক্তের মাশুলে নিজের ইমারত গেঁথেছিলেন সাট্টা কিং৷ কলকাতার যে অন্ধকার জগতের সঙ্গে পাকেচক্রে শৈশবে পরিচয়, সেই কালো জগতকেই করেছিলেন নিজের তুরুপের তাস৷ দীর্ঘ দু দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের হাতে লালন পালন করেছিলেন কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডকে৷ কিন্তু তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর পাপের বেতন এল মৃত্যু হয়েই৷ ১৯৯৩ সালে বউবাজার বিস্ফোরণে আরও অনেকের সঙ্গে প্রাণ হারান তাঁর সদ্য বিবাহিত মেয়ের স্বামীও৷ সাট্টার বুকিদের মতো রশিদের হাতেও রয়ে গিয়েছে হিসেব না মেলা পেন্সিল৷ কদর্য কর্তৃত্বের কমফোর্ট জোন ছেড়ে রশিদ এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত৷ তাঁর মুখের ভাঙাচোরা রেখা খেলা করে গিয়েছে অভিনেতা সুব্রত দত্তর মুখে৷ রশিদ খানের মতো ওজনদার অপরাধীর অভিব্যক্তি নিখুঁত করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি তিনি৷ সায়ন দাশগুপ্তের পরিচালনায় সিরিজের এই পর্ব কাড়বে দর্শক-হৃদয়।
রশিদ খানের ভূমিকায় সুব্রত দত্ত
রশিদ খান ছোট থেকে বুঝেছিলেন জীবনে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে গেলে চাই টাকা। আর হুব্বা শ্যামল নিজেকেই পাখিপড়া করে বুঝিয়েছিলেন যে এই পৃতিবীতে ভয় দিয়ে কেনা যায় সবকিছু। সকলে যত ক্ষণ তাকে ভয় পাবে, তত ক্ষণ তাঁর অপরাধের কারবার সপ্তম স্বর্গে। ভয় দেখানোর জন্য কী-ই না করেছেন শ্যামল! কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত যে ভাবে পৈতে পরা হয়, সেই অংশ বরাবর ফালাফালা করে প্রতিপক্ষ বা প্রতিবাদীর পেট এমনভাবে চিরে দিতেন, এই পোঁচের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘পৈতে কাট’৷ নিজের হাতে অস্ত্রের মোচড়ে দেহ ছিন্নভিন্ন করেই থামতেন না তিনি৷ খুব রাগ থাকলে খুনের পর পেট ফালাফালা করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বার করে সেখানে ভারী পাথর ভরে দেহ ফেলা হত জলে৷ এর সঙ্কেত-নাম ‘ফুটবল’৷ নিজের হাতে মানুষের মাংস কাটার স্টাইলের মতো একটা নতুন নাম পেলেন শ্যামল নিজেও৷ তাঁর নামে আগে বসল ‘হুব্বা’৷ খুন-তোলাবাজির রক্ত ও ত্রাসের কারবারিতে হুব্বা শ্যামল ছিলেন একচ্ছত্র৷ পুলিশের জালে ধরা পড়েও লাভ হয়নি৷ সাক্ষীর অভাবে বেকসুর খালাস৷ শোনা যায়, নিজের হাতে তৈরি শাগরেদের হাতে একদিন পৈতে কাট হয়েছিল হুব্বা শ্যামলেরও৷ এরকম একজন ঘৃণ্য অপরাধীকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে যে মুনসিয়ানার দরকার, তা ষোলো আনা দেখিয়েছেন রুদ্রনীল ঘোষ৷ ভাবলেশহীন মুখে অভিব্যক্তিহীন চাউনি নিয়ে রুদ্রনীল হিমস্রোত বইয়ে দেন মেরুদণ্ডে৷ পাঁচপর্বের সিরিজের শেষ অংশ হিসেবে শ্রীমন্ত সেনগুপ্তর পরিচালনায় এই এপিসোড দর্শক মন পেতে অব্যর্থ৷
আরও পড়ুন : বিশ্বাসে মিলায় অন্বেষণ, তর্কে বহুদূর…পড়ুন আরো এক পৃথিবী-র রিভিউ
হুব্বা শ্যামলের ভূমিকায় রুদ্রনীল ঘোয
সেবাযত্নের মতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের সূত্রপাতও বোধহয় বাড়িতেই৷ এই সিরিজের পাঁচ খুনিই ধারাবাহিক ঘাতক৷ রক্তের নেশা তাঁদের করে তুলেছে ‘গণশত্রু’৷ কিন্তু কেন তাঁরা এই পথের পথিক হলেন, সে ব্যাখ্যাও আছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়ালে দেখা যাবে গণ বা সমাজই তাঁদের টেনে এনেছে এই পঙ্কিল পথে৷ তাঁরা গণের শত্রু, নাকি সমাজই তাঁদের সামনে নরকের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে-সে দ্বন্দ্ব আরও দগদগে হয়ে উসকে ওঠে৷ তাই প্রতি পর্বের দৈর্ঘ্য আরও একটু বেশি হলে, অপরাধী মনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে চিত্রনাট্যে আরও কিছুটা অংশ থাকলে সলতে পাকানোর কাজ ভাল হত৷ এই টুকু বাদ দিয়ে তথ্যচিত্রের আমেজে জারিত এই সিরিজ দর্শকদের ভাল লাগবে প্রাক শীতের আবহে৷
