যাঁরা সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত, ‘আমাদের কথা’ এবং ‘একেই বলে শুটিং’, ‘মাই ইয়ার্স উইথ অপু ‘ যাঁদের বহুপঠিত, এই ছবি থেকে তাঁদের নতুন করে জানার কিছু নেই-এ কথা বলছেন অনেকেই ৷ কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সময়যাপন-এটা কি কম পাওয়া? এখানেই বাজিমাত অনীকের ৷ ‘অপরাজিত’-তে কুশীলব নির্বাচন তাঁর তুরুপের তাস ৷ এবং অনীকের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা তাস হয়ে উঠতে জিতু কমল যে কী অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন, তার প্রমাণ এই ছবির প্রতি মুহূর্তে ৷ তিনি সত্যজিৎ রায়ের হাঁটা, চলা, কথা বলার ভঙ্গি শুধুমাত্র অনুকরণ করেছেন বললে খুব কম বলা হবে ৷ বলা ভাল, তিনি সত্যজিৎ-চর্যার সঙ্গে বিলীন করেছেন নিজেকে ৷ এতটাই অধ্যবসায়, এক বারের জন্যেও মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন ৷ এই সাবলীল ও অনায়াস যাপন শুধু দাঁতের গঠন পরিবর্তন করে আসে না ৷ আসে অন্তঃস্থল থেকে ৷ তবে জিতুর এই প্রয়াস শীর্ষে পৌঁছতে পারত না, যদি না তাঁর কণ্ঠে চন্দ্রাশিস রায় এবং রূপসজ্জায় সোমনাথ কুণ্ডু থাকতেন ৷ জিতুর অভিনয়, চন্দ্রাশিসের কণ্ঠ, সোমনাথের হাতের জাদু, দেবজ্যোতি মিশ্রর সুর এবং অনীকের মগজাস্ত্রের সফল রসায়নে পর্দায় অপরাজিত রায়ের মধ্যে হাজির স্বয়ং কিংবদন্তি ৷
advertisement
‘অপরাজিত’-তে ডাবিং প্রসঙ্গেও অনীকের কথা বলতে হয় ৷ ননীবালা দেবীর চরিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁরই কণ্ঠ ৷ এখানেও কুশীলব নির্বাচনে চমকে দিয়েছেন অনীক৷ বহু সন্ধানেও ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রে অবিনশ্বর চুনীবালা দেবীর মতো কাউকে পাননি তিনি৷ কিন্তু লোলচর্ম এই বৃদ্ধাকে ছাড়া তো ‘পথের পাঁচালী’-র মতো ‘পথের পদাবলী’-ও অচল ৷ শেষে অনীক শরণাপন্ন হন গ্রামবাংলার লোকশিল্পের৷ সেখানেই তাঁর আবিষ্কার হরবাবু ৷ এই বৃদ্ধ প্রায় সাত দশক পর ফিরিয়ে এনেছেন এক ও অদ্বিতীয় চুনীবালাদেবীকে ৷ অভিনয়, রূপসজ্জা, ডাবিং ও পরিচালনার গুণে কেউ বুঝতেই পারবেন না ইন্দির ঠাকরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন একজন পুরুষ !
এছাড়াও বিমলার চরিত্রে সায়নী ঘোষ, সুরমার ভূমিকায় অনসূয়া মজুমদার, বরুণা তথা সর্বমঙ্গলার ভূমিকায় অঞ্জনা বসু, সুবীর মিত্রর ভূমিকায় দেবাশিস রায় যথাযথ ৷ প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আদলে তৈরি বিমান রায়ের ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ছায়ায় জওহর কলের চরিত্রে বরুণ চন্দের অভিনয় এই ছবির অন্যতম সেরা প্রাপ্তি ৷
আরও পড়ুন : ছুটে গিয়ে কেক খাওয়ালেন মাকে, পল্লবীর শেষ জন্মদিনের মুহূর্তে নেটিজেনদের চোখে জল
‘পথের পাঁচালী’ সম্পূর্ণ করার বন্ধুর যাত্রাপথের পাশাপাশি ‘অপরাজিত’-তে উঠে এসেছে তৎকালীন সময়পর্বও ৷ তখন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, এবং হিন্দিতে ‘দেবদাস’ বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে ৷ সে সময়েও স্টুডিওপাড়ায় দাঁড়িয়ে তারকা সুনন্দাদেবীকে গুরুত্ব দিতে অনাগ্রহী নবাগত পরিচালক অপরাজিত রায় ৷ পূর্ববর্তী বাংলা চলচ্চিত্র নয়, তাঁর উপর পাশ্চাত্যের ছবির প্রভাব যে অনেক বেশি, সে কথাও দ্বিধাহীন কণ্ঠেই স্বীকার করছেন অপরাজিত রায় ৷
তাঁর পরিচালক হয়ে ওঠার সলতে পাকানোর পর্ব যে শুরু হয়েছিল বিজ্ঞাপনের অফিসের স্টোরি বোর্ডে, সেই প্রসঙ্গ এ ছবিতে তাৎপর্যপূর্ণ ৷ সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্বের নেপথ্যে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর ভূমিকাকেও অভিবাদন জানিয়েছে এই ছবি ৷ এই খুঁটিনাটির সঙ্গেই থাকবে নামকরণের প্রসঙ্গ ৷ ‘অপরাজিত’ সত্যজিৎ রায়ের বায়োপিক নয় ৷ তাই সুকুমারতনয় সত্যজিৎ এখানে শ্রীকুমারপুত্র অপরাজিত রায় ৷ বিজয়া রায় হয়ে গিয়েছেন বিমলা রায়৷ তাঁর ডাকনাম মঙ্কু থেকে মিঙ্কু৷ তাঁদের শিশুপুত্রর নাম ছবিতে বাবুসোনা ৷ সত্যজিৎজননী সুপ্রভাদেবী হয়ে গিয়েছেন সুরমা ৷ সৃষ্টি আর স্রষ্টাকে মিলিয়ে দিয়েছেন অনীক ৷ তাঁর ছবির চিত্রনাট্যে মানিক হয়ে গিয়েছেন অপু (অপরাজিতর ডাকনাম), অপুর নাম এখানে মানিক ৷ শান্তিপুর গ্রামে মানিক থাকে তার দিদি উমার সঙ্গে ৷ তাঁদের মা সর্বমঙ্গলা এবং বাবা, হরিমাধব ৷
আরও পড়ুন : ‘হয়তো অধিকার ছাড়াই ইন্টারফেয়ার করতাম...’, ‘বোন’ পল্লবীর জন্য বাকরুদ্ধ সোহিনী
নামকরণ পর্ব তো থামতে পারেনি এখানেও ৷ ছবির ভিতরে ছবি ৷ তাই নাম দিতে হয়েছে দু’ভাগে ৷ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছেন বরুণা ৷ কানু বন্দ্যোপাধ্যায় ডুব দিয়েছেন ভানুবাবু পরিচয়ে ৷ কিন্তু যেখানে নামকরণে এত চমক, সেখানে ‘পথের পদাবলী’-র লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় কেন ? ওই নামে আর এক যশস্বী সাহিত্যিক তো আছেন ৷ যখন ‘আম আঁটির ভেঁপু’-র বদলে ‘তালপাতার বাঁশি’-র প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে অপরাজিত রায় মুগ্ধ, তখন সাহিত্যিকের জন্য অন্য পদবি কি খুঁজে পাওয়া যেত না ? তবে সাহিত্যিকের প্রতি সম্মান এখানে অটুট ৷ বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমাদেবীর চরিত্রটি স্বল্প পরিসরে খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন মানসী সিনহা ৷ অপরাজিত রায়কে যখন তিনি ‘পথের পদাবলী’ ছবি করার অনুমতি দিচ্ছেন, পিছনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবছা প্রতিকৃতি দৃশ্যায়নের অন্য মাত্রা এনে দেয় ৷ একইরকম দক্ষতায় ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে সুকুমার রায়ের প্রতিকৃতি ৷
এই ছবি হল বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে ছবির দুনিয়ায় সত্যজিৎ রায়ের পা রাখার যাত্রাপথ এবং সূত্রপাতেই সাফল্যের বিন্দুতে দর্শকদের চোখে আগামীর সিন্ধুদর্শন ৷ তাই স্বভাবতই দৃশ্যায়ন জুড়ে আছে ‘পথের পাঁচালী’-র ক্ষণজন্মা মুহূর্তগুলি ৷ এখানে অনীক এবং তাঁর ইউনিটের প্রত্যেকে সেরাটুকু উজাড় করে দিয়েছেন ৷ ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু, কাশবন পেরিয়ে রেলদর্শন, ইন্দ্রলুপ্তের উপর প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা, দুর্গার নবধারাস্নান, মলিন শাড়ির আঁচলে ভাইকে জড়িয়ে গাছতলায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ‘লেবু পাতায় করমচা’, দুর্গার জন্য আনা ডুরে শাড়ি আঁকড়ে তারসানাই-বহু দিন পর প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে এনেছে বাংলা ছবির দর্শকদের মুগ্ধ করতালি ৷ আইকনিক দৃশ্যগুলির নবনির্মাণে যথাযথ সঙ্গত করেছেন দেবী তথা উমার ভূমিকায় অনুষা বিশ্বনাথন এবং মানিকের চরিত্রে আয়ুষ্মান মুখোপাধ্যায় ৷ তবে অনুষা-সহ ছবির অন্যান্য কিছু চরিত্রের উচ্চারণ ও স্বর প্রক্ষেপণ আরও একটু কম শহুরে হলেই হয়তো ভাল হত ৷ ঘন কাশবনে ভাইকে আখ ছুড়ে দিয়ে উমা দাশগুপ্তর কণ্ঠে ‘খা না!’ শব্দদু’টির সেই ধমকের সুর এখানে ম্রিয়মাণ ৷ অপুর প্রশ্ন ‘কোথায় এলাম রে?’,‘ওগুলো কী রে?’-এর উত্তরে দুর্গার আখ চিবোতে চিবোতে সেই নিস্পৃহতার ঠোঁট ওল্টানোও পাওয়া গেল না ৷ পরিবর্তে এই প্রজন্মের কিশোরীর কাঁধের ভঙ্গি কিঞ্চিৎ বেমানান ৷ ছবির শেষ লগ্নে কানে লাগে চিত্রনাট্যের ‘দারিদ্রতা’ শব্দটিও ৷ তবে চারুলতার সুরের সঙ্গে সমাপ্তিতে এ সবই খড়কুটোর মতো ভেসে যায় মুগ্ধতার স্রোতে ৷
আরও পড়ুন : ‘‘আমাদের কোনও কথার দরকার নেই...’’ বাহুলগ্না পল্লবীর মুহূর্তরা আজ স্মৃতি
শতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণের আগেও নিজের অন্য ছবিতে সত্যজিৎ রায়কে কুর্নিশ জানিয়েছেন গুণমুগ্ধ অনীক ৷ ‘অপরাজিত’ জুড়েও উচ্চারিত হয়েছে ‘বারীন ভৌমিক’, ‘ভূস্বর্গ’, ‘দেখি তোমার আঙুলগুলো’, ‘জীতে রহো’, ‘সাবাশ’, ‘মিস্টার মিটার’, ‘কাল্টিভেট’-এর মতো সত্যজিৎ-শব্দবন্ধ ৷ সেই তালিকায় দর্শকদের তরফে যোগ হয়েছে নতুন বিশেষণ ৷ তাঁরা বলছেন পরিচালক অনীক এবং তাঁর ছবি ‘আর্ডিনারি’ নয়, ‘এক্সট্রাআর্ডিনারি’ !